প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৩ এপ্রিল : খুনিদের নিখুঁত পরিকল্পনার কাছে কার্যতই যেন দিশেহারা পুলিশ।তাই হয়তো রাজ্যের খনি অঞ্চলের বেতাজ বাদশা রাজু ঝা কে খুনের ১২ দিন পরেও খুনিরা অধরাই রয়ে গিয়েছে । তারই মধ্যে চাঞ্চল্যকর তথ্য হল আততায়ীদের নিয়ে পালানো সাদা রঙের অন্য একটি গাড়ির শেষ লোকেশন পুলিশ খুঁজে পেয়েছে বিহারের ভাগলপুরে । আততায়ীরা রাজুকে এলোপাথারি গুলি করার পর নীল গাড়িতে চড়ে তারা শক্তিগড় থানার কিছুটা দূর পর্যন্ত যায় । সেখানে নীল গাড়িটি ফেলে রেখে তারা সাদা রংয়ের অন্য আরেকটি গাড়ি চড়ে চম্পট দেয়। বিভিন্ন টোল প্লাজার ফুটেজ খতিয়ে দেখে পুলিশ এমনটাই তথ্য পেয়েছে বলে সূত্রের খবর ।
তবে এই রাজ্যের বিভিন্ন জেলা ও পড়শী রাজ্য চষে বেড়িয়ে পুলিশ খুনিদের ব্যবহৃত গতিবিধির তথ্য উদ্ধার করতে পারলেও পুলিশ কিছুতেই খুনিদের নাগাল পাচ্ছেনা । ফোন কলের পরিবর্তে খুনিরা ‘কলিং অ্যাপ’ ব্যবহার করাতেই পুলিশকে এত বিপাকে পড়তে হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে ।খুনিদের নাগাল পেতে পুলিশের এখন ভরসা খুনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জালমুড়ি বিক্রেতার দেওয়া বিবরণ অনুযায়ী আঁকা খুনিদের স্কেচ। যা এই রাজ্যের প্রতিটি থানা ও পড়শী রাজ্যের পুলিশের কাছেও পৌছে দেওয়া হয়েছে ।
কয়লা পাচার মামলায় রাজু ঝার গত ৩ এপ্রিল ‘ইডি’ দপ্তরে হাজিরা দেওয়ার দিন ছিল । তার ঠিক এক দিন আগে অর্থাৎ গত পয়লা এপ্রিল রাত্রি পৌনে ৮ টা নাগাদ শক্তিগড়ে কলকাতা মুখী ২ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে একটি ল্যাংচার দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায় সাদা রঙের একটি ফরচুনা গাড়ি। ওই গাড়ির চালকের পাশের শিটে বসে ছিলেন রাজু ঝা। একই গাড়ির পিছনের আসনে বসে ছিলেন রাজু ঝার সহযোগী ব্রতীন মুখোপাধ্যায় ও সিবিআইয়ের তদন্তাধীন গরু পাচার মামলায় ফেরার অভিযুক্ত আব্দুল লতিফ । রাজু ঝায়ের গাড়ি শক্তিগড়ে ল্যাংচার দোকানের সামনে দাঁড়ানোর কিছু সময়ের মধ্যেই সেখানে এসে দাঁড়ায় শার্প শুটারবাহী নীল রঙের একটি চারচাকা গাড়ি । এরপর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ওই গাড়ি থেকে নেমেই দুই শার্পশুটারা পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে পর পর গুলি চালিয়ে রাজু ঝার শরীর ঝাঁঝরা করে দিয়ে পালিয়ে যায় । রাজুর পিছনের শিটে বসে থাকা ব্রতীন মুখোপাধ্যায়ের শরীরে গুলি না লেগে বাম হাতে গুলি লাগায় তিনি জখম হলেও প্রাণে বেঁচে যান । শুটাররা এমন হাড়হিম করা হামলা চালানোর সময়েই বেপাত্তা হয়ে যান আব্দুল লতিফ । অক্ষত থাকেন রাজু ঝার গাড়ির চালক নূর হোসেনও ।
এই পুরো হত্যা কাণ্ড খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করে যিনি কিংকর্তব্য বিমুখ হয়ে পড়েছিলন তিন হলেন শক্তিগড়ের ঝালমুড়ি বিক্রেতা আবুজিয়া সেখ ।পুলিশ ওই ঝালমুড়ি বিক্রেতার মুখ থেকে গোটা ঘটনা বৃত্তান্ত জানে ।এমনকি ওই ঝালমুড়ি বিক্রেতার দেওয়া শারীরিক বর্ণনা অনুযায়ী আততায়ীদের স্কেচও আঁকায় পুলিশ । এছাড়াও রাজু ঝা খুন হওয়ার দিন রাজু ঝার সঙ্গে একই গাড়িতে আব্দুল লতিফের উপস্থিত থাকার কথা সহ গোটা ঘটনা উল্লেখ করে নুর হোসেন শক্তিগড় থানায় এফআইআর দায়ের করেন । তার ভিত্তিতে খুনের ধারায় মামলা রুজু করে ও ’শিট“ গঠন করে পুলিশ রাজু ঝা হত্যা কাণ্ডের তদন্তে নামে ।
পুলিশ তদন্তে নেমেই আততায়ীদের ব্যবহৃত নীল চারচাকা গাড়িটির সন্ধান শুরু করে । ঘটনার দিন গভীর রাতেই শক্তিগড় পুলিশ ঘটনাস্থলের অনতি দূরে নীল গাড়িটির হদিশ পায় । ওই গাড়িটিতে তল্লাশী চালিয়ে পুলিশ আগ্নেআস্ত্র ,কার্তুজ,মদের বোতল ও একাধিক নম্বার প্লেট পায় । তার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ আরো নিশ্চিৎ হয় ওই নীল গাড়িতে চেপেই আততায়ীরা শক্তিগড়ে এসেছিল।এরপর থেকেই তদন্তকারী শীটের সদস্যদের তদন্তের যাবতীয় কেন্দ্র বিন্দুতে জায়গা করে নেয় ওই লীল চারচাকা গাড়িটি । শার্প শুটাররা কোথা থেকে ওই নীল গাড়িতে চাপে এবং কোন কোন পথ ধরে এসে তারা শক্তিগড়ে পৌছায়,তার তথ্য অনুসন্ধানে নামে । সেই তথ্য পাবার জন্য শিটের তদন্তকারী দল এই রাজ্যের বাঁকুড়া,পুরুলিয়া সহ পড়শী রাজ্য বিহার ও ঝাড়খণ্ড চষে বেড়ায় । ওইসব জায়গার বিভিন্ন পয়েন্টের ও দীর্ঘ সড়ক পথের একাধিক ’টোল প্লাজার সিসিটিভির ফুটেজ খতিয়ে দেখে পুলিশ আততায়ীদের নীল গাড়িটির যাতায়াতের অকাট্য তথ্য প্রমাণ পেয়েছে বলেই খবর । এই সবের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনার দু’দিন বাদ জেলা পুলিশ সুপার কামনাশিস সেন আশা প্রকাশ করে বলেছিলেন ‘খুব শিঘ্র ব্রেক থ্রু পাওয়া যাবে’ ।
কিন্তু পুলিশ সুপার ‘ব্রেক থ্রু’ পাবার ব্যাপারে আশা
প্রকাশ করলেও তা এখনও জটিল জটেই আটকে রয়েছে । তবে সূত্রের খবর ,সিসিটিভি ফুটেজের সূত্র ধরে তদন্তকারীরা একপ্রকার নিশ্চিৎ হয়েছেন যে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্য আততায়ীরা ঘটনার আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয় । বিহার,ঝড়খন্ড ,পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া হয়ে আততায়ীবাহী নিল গাড়িটি যে দুর্গাপুরে আসে সেটাও পুলিশ জানতে পেরেছে । এই দীর্ঘ যাত্রা পথে আততায়ীরা তাদের নীল গাড়ির নম্বার প্লেট যে একাধিক বার বদল করেছিল সেই ব্যাপারেও পুলিশ নিশ্চিৎ হয়েছে । তদন্তে এও উঠে এসেছে ঝাড়খণ্ডের একটি শো রুমে আততায়ীরা তাদের নীল চারচাকা গাড়ির টায়ারে ’নাইট্রোছেন গ্যাস’ ভরে । মদও কেনে ঝাড়খণ্ডের একটি মদের দোকান থেকে। নীল গাড়িটি ৩০ মার্চ দুপুর ২ টোর খানিক পর বাঁকুড়ার ’কালাপাথর’ টোল প্লাজায় ১৩০ টাকা টোল মিটিয়ে পার হয় । ওই টোলা প্লাজার সিসিটিভি ফুটেজে নীল গাড়িটিতে চারজন সওয়ার থাকার ছবিও ধরা পড়েছে বলে খবর ৷ এছাড়াও দুর্গাপুরের কাঁকশার বাঁশকোপায় টোল প্লাজার সিসিটিভি ফুটেজেও একই গাড়ির সামনের দিকে চালক সহ দু’জন বসে থাকার ছবি ধরা পড়েছে বলে জানা গিয়েছে। গত ৩১ মার্চ বিকালে কাঁকশার রাজবাঁধে থাকা রাজু ঝার ফরচুনা হোটেলের সামনে নীল গাড়িটির পাক মারার ছবিও সেখানকার সিসিটিভির ফুটেজে ধরা পড়েছে ।এছাড়াও ঘটনার দিন দুপুরে রাজু ঝার হোটেলের সামনে দাঁড়ানো সাদা ফরচুনা গাড়িটিতে একটি ট্রলি ব্যাগ ও অফিস ব্যাগের মত অন্য একটি ব্যাগ তোলা হচ্ছিল তখনও হোটেলের সামনে সেই নীল গাড়ির পাক মারার ছবি ধরা পড়েছে । এর পর রাজু সহ বাকিরা ওই সাদা ফরচুনা গাড়িতে চেপে রওনা হওয়ার পরেই নীল গাড়িটি রাজুদের গাড়ির পথ অনুসরন করা শুরু করে ।
এদিকে আততায়ীদের ব্যবহার করা গাড়ির এত তথ্য উদ্ধার করা গেলেও পুলিশকে আততায়ীদের ফোন কলের তথ্য ও টাওয়ার লোকেশন ট্র্যাক করতে হিমশিম হচ্ছে । তাই মনে করা হচ্ছে পুলিশকে ঘোল খাইয়ে গোটা শুটআউট প্রক্রিয়া সারতে আগাগোড়া ’কলিং অ্যাপ’ ব্যবহার করেছে রাজু ঝা কে হত্যা কাণ্ডে জড়িত আততায়ীরা । তাই দুই শার্প শুটারের নাগাল পেতে পুলিশের এখন বড় ভরসা প্রত্যক্ষদর্শী ঝাল মুড়ি বিক্রেতার দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী আঁকা শুটারদের স্কেচ । যা ইতিমধ্যেই এই রাজ্যের বিভিন্ন থানা ও পড়শী একধিক রাজ্যের থানা গুলিতে পাঠানো হয়েছে । এইটুকু করেই অবশ্য হাল ছাড়েনি পুলিশ । বুধবার হাজারীবাগ কেন্দ্রীয় জেলে যায় শিটের তদন্তকারী দল। রাজু ঝা খুনের ঘটনা নিয়ে তারা সেখানে উত্তরপ্রদশের গ্যাংস্টার আমান সিংকে প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে । রাজু ঝা খুনের ঘটনা সম্পর্কে কোন প্রশ্নেরই উত্তর আমন সিং দেয়নি । এমনকি তদন্তকারীরা আমান সিংয়ের কাছে ধানবাদের কুখ্যাত গ্যাংস্টার প্রিন্স খানের সম্পর্কে জানতে চাইলেও সে একই ভাবে নীরব থাকে বলে হাজারীবাগ জেল সূত্রে খবর । তবে অবশ্য রাজু ঝা কে খুনের ঘটনায় জড়িত শুটারদের জালে পুরতে তদন্তকারীরা সর্বতোভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ।।