দীর্ঘ ৩৪ বছরের বামফ্রন্টের শাসনকালে একের পর নরসংহার প্রত্যক্ষ করেছিল পশ্চিমবঙ্গবাসী । বিজন সেতুতে আনন্দমার্গির সন্নাসী ও সন্নাসীনিদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা,মরিচঝাঁপি গণহত্যা, সাঁইবাড়ি হত্যাকাণ্ড,২১ জুলাই মহাকরণ অভিযান,নানুর হত্যাকাণ্ড,ছোট আঙারিয়া,নন্দীগ্রামের গনহত্যা, নেতাই গণহত্যা প্রভৃতি একের পর এক নরসংহারের সাথে জুড়ে গেছে বামপন্থী সিপিএমের নাম । সেই সমস্ত গনহত্যার নৃশংসতার ইতিহাস পড়ে আজও শিহরণ জাগে সাধারণ মানুষের মনে । আর তার পরিনতি আজও ভোগ করছে তথাকথিত ‘সর্বহারাদের’ ওই দলটি ৷ তবে সিপিএম বিদায় নেওয়ার পরেও গনহত্যার পরম্পরা বন্ধ হয়নি এরাজ্যে ৷ আজ থেকে ঠিক ৩ বছর আগে,মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের শাসনে বীরভূম জেলার বগটুইয়ে ঘটেছিল একটি নৃশংস বর্বরোচিত গনহত্যার ঘটনা । দশজনকে নিজের বাড়ির মধ্যেই জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল । তবে সিপিএমের নৃশংসতার শিকার হয়েছিল মূলত বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য ও সাধারণ মানুষ ৷ কিন্তু বগটুইয়ের ঘটনা ছিল তৃণমূলের অন্তর্দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ ।
আজ শুক্রবার বগটুই গণহত্যার তৃতীয় বর্ষপূর্তি। আজও বগটুইবাসীর নাকে লেগে আছে মানুষের পোড়া চামড়ার গন্ধ । ঠিক কি ঘটেছিল সেদিন ? আসলে, ২০২২ সালের ২১ মার্চ রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ রামপুরহাটে জাতীয় সড়কের ধারে বোমা মেরে খুন করা হয় তৃণমূল কংগ্রেস শাসিত স্থানীয় বড়শাল গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ভাদু শেখকে। তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের পরিনতিতে খুন হয় ভাদু । সেই খুনেরই বদলা নিতে বগটুই গ্রামে সেদিন গভীর রাতেই হামলা করে মৃত তৃণমূল নেতার অনুগামীরা । বেছে বেছে ভাদুবিরোধী অন্তত ১২জন গ্রামবাসীর বাড়িতে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগানো হয় । সেই সময় পরিবারের সকলে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল । ফলে যায় ৯ বছরের শিশু থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধাসহ ১০ জন জীবন্ত পুড়ে মারা যায় । এমনকি শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে আসা সদ্য বিবাহিত মেয়ে জামাইকেও হিংসার আগুনে পুড়ে মরতে হয়।
ওই বছরের ২৪ মার্চ বগটুই গ্রামে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি । তিনি মৃতদের পরিবারের হাতে সাহায্যের চেক তুলে দিয়ে আসেন । তাঁর নির্দেশে তৃণমূল কংগ্রেসের তৎকালীন ব্লক সভাপতি আনারুল হোসেন গ্রেফতার হয়। ঘটনার তদন্তভার তুলে দেওয়া হয় সিবিআইয়ের হাতে । ওই বছর ডিসেম্বর মাসে সিবিআই হেফাজতে মৃত্যু হয় ‘গনহত্যার মাস্টারমাইন্ড’ লালন শেখের। বিজেপির পক্ষ থেকে স্বজনহারা মিহিলাল শেখের দেওয়া জায়গায় শহিদবেদি তৈরি করা হয় ন।
গত বছরের আগস্ট মাসে গণহত্যার মামলায় রামপুরহাট আদালতে সাক্ষ্য নেওয়া হলে মৃতদের পরিবার পরিজনরা জানিয়েছিলেন যে তৃণমূলেরই এক গোষ্ঠী এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল । মামলার মূল সাক্ষী মিহিলাল সেখ, বাণিরুল সেখ ও সেখলাল সেখরা । মিহিলাল সেখ আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন যে তিনি অভিযুক্তদের প্রতিবেশী হিসাবে চিনলেও, তারা অপরাধ সংঘটিত করেছিল কি না দেখেননি তিনি। কারণ, সেই সময় পালিয়ে গিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই এই নৃশংস হত্যাকান্ডে স্ত্রী, সন্তানকে হারানো মিহিলাল সেখের এমন অবস্থান বদলের পেছনে শাসকদলের ‘চাপ’ করছিল বলে সন্দেহের সৃষ্টি হয় । এই সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয় যখন বগটুই গণহত্যায় মাকে হারানো খুশি খাতুন পুরো ঘটনাই অস্বীকার করেন ! অথচ এই খুশি খাতুন ঘটনার পরপরই, তাঁর পরিবারের সদস্যরা যখন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিলেন, তখন সংবাদ মাধ্যমের সামনে রীতিমত নাম ধরে ধরে অভিযুক্তদের পরিচয় প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় সম্পূর্ণ পালটে যায় তাঁর অবস্থান। স্ত্রীকে হারানো নেকলাল সেখও খুশি খাতুনের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন । ফলে যেভাবে সিপিএমের শাসনকালে কোনো গনহত্যারই ন্যায় বিচার হয়নি,তেমনি তৃণমূলের শাসনে বগটুইয়ের গনহত্যার ন্যায়বিচারের আশা ক্ষীণ বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ ।
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী মৃতদের শ্রদ্ধা জানিয়ে আজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, ‘আজ বগটুই গণহত্যার তৃতীয় বর্ষপূর্তি। মমতা পুলিশের মদতে তৃণমূলের হার্মাদ বাহিনীর নৃশংস হামলায় নিহত বগটুইবাসীদের স্মরণ করি।সকল নিহতদের বিনম্র শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাই।’।