জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,আউশগ্রাম(পূর্ব বর্ধমান),০৭ নভেম্বর : ধীরে ধীরে গ্রাম বাংলার মেয়েরা কি যোগ, ফুটবল, বক্সিং, ক্যারাটে, ক্রিকেট সহ ক্রীড়া জগতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে? রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান সেই দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। উড়িষ্যার অনুর্দ্ধ-১৫ মহিলা ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে চলছে সীমিত ওভারের প্র্যাকটিস ম্যাচ। বাংলার হয়ে বল করতে এগিয়ে এল একটি ছিপছিপে মেয়ে। তার বিষাক্ত বোলিংয়ের দাপটে বিভ্রান্ত উড়িষ্যার ব্যাটসম্যানরা । ৪ ওভার বল করে মাত্র ৩ রানের বিনিময়ে ১ টি উইকেট দখল করে। এরমধ্যে ২ টি মেডেন ওভার।
এখানেই শেষ নয়। এর আগে অনুর্দ্ধ-১৪ আন্তঃজেলা সীমিত একদিবসীয় মহিলা ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় পশ্চিমাঞ্চলের বিরুদ্ধে মেয়েটি ৩ টি উইকেট দখল করেছিল । পূর্বাঞ্চল হেরে গেলেও তার নিখুঁত নিশানা, বোলিং অ্যাকশন ও বিপক্ষ ব্যাটসম্যানের উইকেট লক্ষ্য করে বল করা – সংশ্লিষ্ট নির্বাচকদের মুগ্ধ করে। এই মেয়েটি হলো আউশগ্রামের কুড়ুম্বা গ্রামের আদিবাসী কন্যা বিন্তি মুর্মু, স্থানীয় একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রবিলাল মুর্মুর ইচ্ছে ছিল কন্যা বিন্তি সহ আদিবাসী মেয়েদের নিয়ে একটা ফুটবল টিম গড়ে তোলা। পরিস্থিতি প্রতিকূল হলেও শুরুটা হয়েছিল ভাল। গ্রামের আদিবাসী কন্যা, অভাবের সংসার – তাও ওরা রবিলালের তত্ত্বাবধানে নিয়মিত অনুশীলন করত। কিন্তু করোনা জনিত লকডাউন সব কিছু এলোমেলো করে দেয়। সরকারি নির্দেশে অনুশীলন বন্ধ হয়ে যায়।
হতাশ হননি রবিলাল বাবু। চার দেওয়ালের মধ্যেই মেয়েকে নিয়ে বল ছোড়াছুড়ি করতে থাকেন। মেয়ের বল ছোড়ার ভঙ্গি দেখে তাকে ক্রিকেটার হিসাবে গড়ে তুলতে ইচ্ছে হয়। নিয়ে আসেন গুসকরার একটি ক্রিকেট কোচিং সেণ্টারের কর্মকর্তা সৌগত গুপ্তের কাছে। সৌগতবাবুর বক্তব্য,’বিরল প্রতিভার অধিকারী বিন্তি। তার বোলিং অ্যাকশন অসাধারণ। বঞ্চনার শিকার নাহলে এই মেয়েটি শুধু বাংলা নয় ভারতের মুখ উজ্জ্বল করবে।’
বিন্তির বোলিং অ্যাকশন ও নিখুঁত নিশানা দেখে পাকা জহুরীর মত সৌগতবাবু বিন্তির মধ্যে প্রকৃত পেস বোলারের খোঁজ পান। শুরু হয় অনুশীলন। যদিও বিন্তি সেখানে বেশিদিন ছিল না। গুসকরারই অন্য একটি কোচিং সেণ্টারের সঙ্গে যুক্ত হয়। মোটামুটি সেখান থেকেই তার উত্তরণ এবং বাংলার অনুর্দ্ধ-১৫ মহিলা ক্রিকেট দলের প্রথম ১৬ জনের তালিকায় নাম ওঠে। জানা যাচ্ছে আগামী ১৭ই নভেম্বর থেকে হরিয়ানায় যে একদিবসীয় ক্রিকেট প্রতিযোগিতা শুরু হতে চলেছে সেখানে এই দলটি অংশগ্রহণ করবে।
বিন্তির এই সাফল্যের সিঁড়িটা সহজ ছিলনা। আদিবাসী মেয়ে, খেলাধুলা করে কি করবে – বিভিন্ন জনের, এমনকি শিক্ষকদের,কাছ থেকে এই উক্তি বারবার রবিলাল বাবুকে শুনতে হয়েছে। তিনি ভেঙে পড়েননি, মেয়েকে খেলোয়ার হিসাবে গড়ে তোলার সংকল্প থেকে চ্যুত হননি। পাশে পেয়েছেন স্ত্রী বাসন্তীর উৎসাহ। অবশেষে প্রাথমিক সাফল্য পেলেন।
কথা হচ্ছিল বর্ধমানের ক্রিকেট জগতের গর্ব গণেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। একসময় তিনি বাংলার সীমিত বয়সের বিভিন্ন ক্রিকেট দলের সফল খেলোয়ার ছিলেন। তিনি বললেন,’এখানেই থেমে থাকলে চলবে না। আরও এগিয়ে যেতে হবে। এইসব ক্রীড়া প্রতিভার পরিচর্যার দিকে সরকার ও ক্রীড়া সংস্থাগুলিকে নজর দিতে হবে। যথাযথ নজরদারির অভাবে বহু ক্রীড়া প্রতিভা খেলার জগত থেকে হারিয়ে গেছে।’বিন্তির সাফল্য কামনা করে তাকে প্রাণভরা আশীর্বাদ করেন।
মেয়ের সাফল্যে গর্বিত রবিলালবাবু বললেন,’আমি চাই আমার মেয়ে আরও সাফল্য পাক। শুধু আউসগ্রাম নয় সমগ্র বাংলা তথা দেশ যেন তাকে নিয়ে গর্ব করতে পারে ।’।