কঠিন এক সময় পেরিয়ে আসা অন্বেষা তখন খুঁজছিল এমন কাউকে, যে অন্তত নির্জনে তার ভেতরের ঝড়টা শুনতে পাবে। সেই সময়েই তার দেখা হয় কলেজের ইংরেজি সাহিত্য বিভাগের আর এক অধ্যাপিকা ঋদ্ধিমার সঙ্গে। শান্ত স্বভাব, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর প্রচুর বই পড়ার অভ্যাস—ঋদ্ধিমাকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে যায় অন্বেষার।
দুজনেই বইপোকা। প্রথমে সাহিত্য নিয়ে আলোচনার সূত্রে আলাপ, তারপর ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা। অন্বেষা প্রথমবার মনে করে, জীবন হয়তো আবার একটু রঙ ছুঁয়ে যেতে পারে।
ঋদ্ধিমা একদিন জানায়, “জানি না অন্বেষা, তুই সব সময় এতটা চুপচাপ থাকিস কেন। তোর চোখে একটা চাপা কষ্ট লুকিয়ে আছে, যা তুই কাউকে বলতে পারিস না। বলতে ইচ্ছে করে না?”
অন্বেষার চোখ দুটো একটু ভিজে ওঠে। হয়তো এতদিন পরে কেউ সত্যিই তাকে বোঝার চেষ্টা করল। এক বিকেলে কলেজের পেছনে বকুলতলায় বসে সে ধীরে ধীরে খুলে বলে তার জীবনের সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলো। ঋদ্ধিমা চুপ করে শোনে, তারপর বলে, “তুই যুদ্ধ করে বেঁচে আছিস, অন্বেষা। তোকে আমি সম্মান করি। তুই শুধু আজ সফল অধ্যাপিকা নয়, একজন যোদ্ধা।”
ঋদ্ধিমার এই কথাগুলো অন্বেষার ভেতরের এক অন্যরকম শক্তিকে জাগিয়ে তোলে।
এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিন। অন্বেষা পড়াশোনা গবেষণায় ডুবে থাকে ।মন ধীরে ধীরে একটু করে শান্ত হচ্ছিল। তবুও জীবনের একাকিত্বটা কখনও কখনও পিছু নিত। এমনই একদিন, কলেজে একটি সেমিনারে অংশ নিতে এসে পরিচয় ঘটে সৌম্য ঘোষর সঙ্গে।
সৌম্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ স্কলার, অতিথি বক্তা হিসেবে এসেছিলেন সেমিনারে। পরিপাটি পোশাক, সপ্রতিভ উচ্চারণ আর আত্মবিশ্বাসী চেহারায় সৌম্যর মধ্যে এক ধরণের সহজ আকর্ষণ ছিল। সেমিনারে তার বক্তব্য অন্বেষাকে মুগ্ধ করে। পরে আলোচনা চলাকালীন অন্বেষা প্রশ্ন করে—একটা গভীর সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে। সৌম্য উত্তর দেন, কিন্তু উত্তরের গভীরতায় অন্বেষার চোখে নতুন কৌতূহল জাগে।
সেমিনার শেষে সৌম্য নিজেই এগিয়ে এসে বলে,
“আপনার প্রশ্নটা খুব ভালো ছিল। আপনি কি রবীন্দ্র সাহিত্য নিয়ে রিসার্চ করছেন “
অন্বেষা হেসে বলে, “ওই আর কি? একটু পড়াশোনা করছি। তবে জীবনের কিছু অধ্যায় সব সময় আমায় পেছন থেকে টেনে ধরে রাখে ,আমার পথ আগলে রাখে, আমাকে বারবার পিছিয়ে দেয়।”
সৌম্য একটু চুপ থেকে বলে, “জীবনের সব পেছন টেনে ধরার গল্প শেষ নয়, অনেক সময় সেটা আমাদের এগিয়ে যাওয়ার শক্তিও দেয়।”
এরপর থেকে সৌম্যর সঙ্গে অন্বেষার যোগাযোগ শুরু হয়। প্রথমে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা, তারপর ধীরে ধীরে নানা বিষয়ে আলাপ। বই, গান, জীবনদর্শন, এমনকি ব্যর্থতা ও পুনর্জন্ম—সব বিষয়ে কথা হতো তাদের।
ঋদ্ধিমা একদিন মজা করে বলে,
“এই যে অন্বেষা মশাই, আজকাল বেশ হাসিখুশি মনে হচ্ছে। সৌম্য বাবুর অবদান না কী?”
অন্বেষা হেসে ফেলে। সত্যিই, সৌম্যর সঙ্গে কথা বললেই তার মনটা একটু হালকা লাগে। সৌম্য কখনও প্রেমের কথা বলেনি, কিন্তু তার প্রতিটি ব্যবহার, মনোযোগ, আর কথার ভেতরে ছিল এক অদ্ভুত আশ্রয়। যেন বলছিল, “ভয় পেও না, আমি আছি।”
এক সন্ধ্যায় সৌম্য বলে,
“অন্বেষা, আমি জানি তুমি অনেক কষ্টের ভেতর দিয়ে এসেছো। আমি কোনো তুলনা করতে চাই না, শুধু একটা কথা বলি—তুমি চাইলেই নতুন করে শুরু করতে পারো। আমি যদি পাশে থাকি, তোমার কী অসুবিধে?”
অন্বেষা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। সে জানে, সে এখন আর সেই দুর্বল মেয়ে নয়। এখন তার আত্মবিশ্বাস, সম্মান আর স্বপ্ন আছে। তার জীবন সে নিজেই তৈরি করেছে।
“সৌম্য,” সে ধীরে বলে, “তোমার উপস্থিতি আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কিন্তু আমি এখনো নিজেকে ভালোবাসতে শিখছি। একদিন যদি নিজেকে পুরোপুরি ভালোবাসতে পারি, তাহলে হয়তো তোমাকে ভালোবাসার শক্তিও জন্মাবে। তুমি কি অপেক্ষা করতে পারবে?”
সৌম্য হাসে, “আমি অপেক্ষা করব। কারণ আমি জানি, তুমি যদি কখনও ভালবাসো—তা হবে নিঃস্বার্থ আর সম্পূর্ণ। আমি তাতেই খুশি।”
এভাবেই, অন্বেষার জীবনে আবার আসছে এক নতুন সকাল, যেখানে আছে বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, আর নিজের প্রতি বিশ্বাস। এখনও অনেক পথ বাকি, কিন্তু এই পথ চলার সঙ্গী হিসেবে আজ তার পাশে আছে ঋদ্ধিমার বন্ধুত্ব, সৌম্যর শান্ত সহচরতা, আর নিজস্ব এক স্বপ্ন—যা আবার নতুন করে রঙ নিচ্ছে।
ক্রমশ…