প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১২ নভেম্বর : বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী অভিযোগে বেঙ্গালুরুর জেলে বন্দি করে রাখা হয়েছে পশ্চিম বাংলার এক শ্রমিক দম্পতিকে । রেহাই পায়নি তাঁদের দেড়বছর বয়সী শিশু পুত্রও । প্রায় সাড়ে তিন মাসধরে শিশু পুত্র আদিকে সঙ্গে নিয়েই বেঙ্গালুরুর জেলে দিন কাটাচ্ছেন অসহায় দম্পতি পলাশ অধিকারী ও শুক্লা অধিকারী । এক ঘটনা সংক্রান্ত খবর গত ২৪ অক্টোবর এইদিন-এ প্রথম প্রকাশ করে । তার পরেই তোলপাড় পড়ে যায় এই রাজ্যের প্রশাসনিক মহলে।বিভিন্ন সংগঠনও প্রতিবাদে স্বোচ্চার হয় । এইসবের পরিপ্রেক্ষিতে মহা ফাঁপড়ে পড়ে গিয়েছে বেঙ্গালুরুর ভারথুর থানার পুলিশ । তাঁরা এখন পশ্চিম বাংলায় এসে বিভিন্ন প্রশাসনিক দফতরে ঘুরে নথি সংগ্রহ করছেন । তার মাধ্যমে তাঁরা নিশ্চিৎ হতে চাইছেন, তাঁদের করা মামলার জেরে বেঙ্গালুরুর জেলে বন্দি থাকা দম্পতি আদৌ কি বাংলাদেশি ! নাকি তারা প্রকৃতই ভারতীয় নাগরিক । এমনটা জেনে অধিকারী পরিবারের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে,এবার হয়তো পলাশ এবং তাঁর স্ত্রী ও পুত্র জেল থেকে মুক্তি পাবে ।
দম্পতি পলাশ অধিকারী ও শুক্লা অধিকারী
পূর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুর থানার জৌগ্রাম পঞ্চায়েতের তেলে গ্রামের বাসিন্দা । সেখানে রয়েছে তাঁদের টিনের চালার দু’কুঠুরি ভাঙাচোরা বাড়ি। ওই বাড়ি দেখলে যে কেউ বুঝে যাবেন দারিদ্রতাই অধিকারী পরিবারের নিত্যদিনের সঙ্গী । মাথা গোঁজার ঠাঁই টুকুই শুধুমাত্র তাদের সম্বল।পলাশ ও তাঁর পরিবারের সবাই শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন । পলাশের বিবাহিত বোন শম্পা হালদার ও তেলে গ্রাম নিবাসী আত্মীয় পিন্টু হাওলাদার শুক্রবার জানান, বেঙ্গালুরু গেলে একটু ভাল রোজগার হবে, এমনটা প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল পলাশের । তাই স্ত্রী শুক্লাদেবী ও শিশু পুত্র আদিকে সঙ্গে নিয়ে চলতি বছরের জুন মাসের শেষের দিকে পলাশ কর্ণাটক রাজ্যের বেঙ্গালুরূ যান । একই উদ্দেশ্যে পলাশের বাবা পঙ্কজ অধিকারী এবং মা সবিতাদেবীও বেঙ্গালুরু যান । সেখানকার মারাথাহাল্লি (Marathahalli) মহকুমার ভারথুর (varthur) থানার সুলিবেলে(sulibela) গ্রামের কায়েন খাঁনের ডেরায় তারা ওঠেন । সেখানে দৈনিক ৩০০-৪০০ টাকা মজুরির শর্তে তারা কায়েন খাঁনের অধীনে কাজ করা শুরু করেন । তাদের কাজ ছিল হোটেল,রেঁস্তোরা,সিনেমা হল সহ বিভিন্ন জয়গা থেকে সংগৃহীত বর্জ্যবস্তু,বোতল,প্লাস্টিক সরঞ্জাম এইসব বাছাই করা ।
পিন্টু হাওলাদার বলেন,’সেখানে সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল । হঠাৎ করেই গত ২৭ জুলাই ভারথুর (varthur) থানার পুলিশ কায়েন খাঁনের ডেরায় হানা দেয় । সেখানে যাঁরা যাঁরা বাংলাভাষী ছিল তারা সবাই নাকি বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী,,এমন সন্দেহে ভারথুর থানার পুলিশ তাদের ও আরো পাঁচ জনকে পাকড়াও করে থানায় নিয়ে যায়। ওই সময়ে পলাশ,তাঁর স্ত্রী,বাবা-মা সবাই ভারথুর থানার পুলিশকে জানান, তাঁরা কেউই বাংলাদেশী নন। তাঁরা নিজেদেরকে ভারতীয় বলে জানিয়ে আধার কার্ড,প্যান কার্ড,ভোটার কার্ড দেখান। সেইসব দেখে সেখানকার ভারথুর থানার পুলিশ পলাশের বৃদ্ধ বাবা,মাকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু পলাশ এবং তাঁর স্ত্রী ও শিশুপুত্র সহ সাত জনকে ছাড়ে না । তাদের বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী অভিযোগে ভারথুর থানার পুলিশ গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়ে দেয় । সেই থেকে প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে শিশুপুত্র আদিকে সঙ্গে নিয়েই বেঙ্গালুরুর জেলে চোখের জল ফেলেই দিন কাটাচ্ছে পলাশ ও তাঁর স্ত্রী শুক্লা।
ছেলে ,বৌমা ও নাতিকে জেলথেকে মুক্ত করার জন্য পলাশের বাবা ও মা বেঙ্গালুরুতে থেকে নানাভাবে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু সুরাহার কোন ব্যবস্থা না হওয়ায় তাঁরাও যথেষ্ট হতাশ হয়ে পড়েছেন । পলাশের ভগ্নিপতি সুজন হালদার বলেন,’পলাশ এবং তাঁর স্ত্রী ও সন্তান কে যাতে জেল থেকে মুক্ত করা যায় ,তার জন্য তিনিও বেঙ্গালুরুতে থেকে চেষ্টা চালাচ্ছেন । কিন্তু কিছুতেই কিছু করে উঠতে পারছেন না । তবে এইদিন সহ পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম এই সংক্রান্ত খবর প্রকাশ কারার পর ভারথুর থানার পুলিশ একটু যেন চাপে পড়ে গিয়েছে । তাই ভারথুর থানার পুলিশ আধিকারিদের একটি দল পূর্ব বর্ধমানে ছুটে গিয়েছে বলে তাঁরা জানতে পেরেছে ।’
বিডিও( জামালপুর) শুভঙ্কর মজুমদার বলেন, ‘এইদিনে এই খবর দেখে প্রথম জানতে পারি আমার ব্লকের তেলে গ্রামের বাসিন্দা এক দম্পতিকে ফরেনার্স এ্যাক্টে গ্রেপ্তার করেছে বেঙ্গালুরু পুলিশ।শিশু সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা সেখানকার জলে প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে বন্দি হয়ে রয়েছে ।’ বিডিও জানান,এই সংক্রান্ত খবর প্রকাশ হবার পরেই বেঙ্গালুরুর ভারথুর থানার পুলিশ বেকায়দায় পড়ে গিয়ে নড়ে চড়ে বসতে বাধ্য হয়েছে । বিডিও জানান, তিন চারদিন আগে বেঙ্গালুরুর ভারথুর থানার তিন পুলিশ আধিকারিক তদন্তের স্বার্থে তাঁর কাছে আসে। পলাশ অধিকারী ও তাঁদের স্ত্রী প্রকৃতই ভারতীয় নাগরিক কিনা এবং তাদের ভোটার ও আধার কার্ডটি সঠিক কিনা, সেইসব বিষয়ে বেঙ্গালুরু পুলিশ তাঁর কাছে জানতে চায় । এছাড়াও পলাশদের পারিবারিক পরিচিতি, কতদিন ধরে তারা তেলে গ্রামে বসবাস করছে,তাদের কাস্ট স্ট্যটাস সহ নানা বিষয়ে জানতে চায় । সব তথ্য ভারথুর থারার মেইল আইডি তে পাঠিয়ে দিয়েছেন বলে বিডিও জানান ।পশাপাশি তিনি এও বলেন,’দম্পতি যে জৌগ্রামের তেলে গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা সেই বিষয়ে জামালপুর থানার পুলিশও রিপোর্ট পাঠিয়ে দিয়েছে ।’ বিডিও শুভঙ্কর মজুমদার আরও জানানা,ভারথুর থানার তদন্তকারী পুলিশ আধিকারিকরা শুধু জামালপুর বিডিও অফিস ও থানায় এসে তথ্য যাচাই করে ফিরে গিয়েছেন, এমনটা নয়। বেশ কয়েকদিন ধরে ওই পুলিশ আধিকারিক দল জামালপুরের জমি রেজিস্ট্রি অফিস,ভূমি দফতরের অফিস,জৌগ্রাম পঞ্চায়েত, এমনকি বর্ধমান দক্ষিন মহকুমা শাসকের অফিসেও তথ্য যাচাইয়ের জন্য গিয়েছিল ।
পলাশের বোন শম্পা হালদার বলেন,বেঙ্গালুরু
পুলিশ আধিকারিক দল আমাদের তেলে গ্রামের বাড়িতে এসেছিল। বাড়ি ঘর ঘর দেখার পাশাপাশি ওই পুলিশ দল আমার দাদা ,বৌদি ও ভাইপোর ভারতীয় নাগরিকত্ত্ব সংক্রান্ত সব নথিও যাচাই করে।পাড়া প্রতিবেশীদের সঙ্গে তাঁরা কথা বলেন । শুক্লা বলেন,’কোন খুঁত বেঙ্গালুরু পুলিশ বার করতে পারেনি । তাই আমরা প্রত্যাশা করছি, এবার হয়তো বেঙ্গালুরুর জেল থেকে আমার দাদা ,বৌদি ও ভাইপো মুক্তি পাবে ।’