প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,০৮ মার্চ : বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে আছে মাছ।তাই বাঙালিদের মাছে-ভাতে বাঙালি বলা হয়ে থাকে।সেই মাছ অর্থাৎ মৎস চাষ নিয়ে গবেষণায় গোটা বিশ্বে সাড়া ফেলে দেওয়া বাঙালি কন্যা রিনা চক্রবর্তীকে সন্মানিত করলেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু।আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রক্কালে বাংলার এক চাষির কন্যার এই সাফল্যে গর্বিত আপামোর বাঙালি।
রাজ্যের শস্যগোলা হিসাবে পরিচিত পূর্ব বর্ধমান জেলা । এই জেলার খণ্ডঘোষ ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রাম শাঁকারী । অখ্যাত এই গ্রামের চাষি প্রশান্ত চক্রবর্তীর কন্যা ডঃ রিনা চক্রবর্তী।গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শুরু হয় তাঁর শিক্ষা জীবন। বর্তমানে তিনি দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে ’মৎস্য বিজ্ঞান’ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান।তাঁর গবেষণার মূল বিষয় হল,“জলের অপচয় না করে,অল্প জায়গায় অল্প জল সহযোগে কৃত্রিম জলাশয় তৈরি করে বিজ্ঞান সন্মত ভাবে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ“। শুধু এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ’ই নয়,মাছ চাষ করে লাভের দিশাও প্রকাশ পেয়েছে রিনা চক্রবর্তীর গবেষণায়।
মৎস বিজ্ঞান নিয়ে রিনা চক্রবর্তীর এই গবেষণা
শুধু ভারতে নয়,বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছে।
দেশের এমন এক প্রতিভাবান গবেষককে সন্মান জানাতে গত ৩ মার্চ দিল্লীতে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ।সেই অনুষ্ঠানে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু সন্মান জানান রিনা চক্রবর্তীকে। পুরস্কৃতও করেন।অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান,শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডঃ সুকান্ত মজুমদার ছাড়াও দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক সন্মানিত হওয়া কৃষি বিজ্ঞানী ডঃ দিলীপ চক্রবর্তীও উপস্থিত ছিলেন। দিলীপবাবু হলেন গবেষক রিনা চক্রবর্তীর দাদা। এই সকল বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন একাধীক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চান্সেলর সহ বিশিষ্ঠ জনেরা।
রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে সন্মাননা প্রাপ্তির জন্য নিজের বাবা প্রশান্ত চক্রবর্তী,মা স্নেহময়ীদেবী সহ ঈশ্বরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ব্যক্ত করেছেন ডঃ রিনা চক্রবর্তী।তিনি জানান,“পরম ঈশ্বর এবং আমার বাবা-মায়ের আশীর্বাদ আমার প্রতি ছিল বলেই আমি এতবড় সন্মাননা লাভ করেতে পেরেছি। পড়ুয়া জীবনে আমার বাবা- মা আমায় প্রেরণা যোগাতেন ।তাঁরা সবসময় আমায় বলতেন,,“তুই নিজের পায়ে দাঁড়া“। ছাত্রী জীবনের কথা স্মরণ করে রিনা চক্রবর্তী বলেন,’আমি যখন পড়ুয়া ছিলাম তখন পশ্চিমবাংলা এত ’আপডেট’ ছিল না। লেখাপড়া শেখার জন্য তাই আমাকে অনেক স্ট্রাগেল করতে হয়েছে।সেই স্ট্রাগেলের ফল হিসাবেই আমার রাষ্ট্রপতি মহোদয়ার কাছ থেকে সন্মাননা লাভ সম্ভব হয়েছে।
নারী দিবস ৮ মার্চের প্রাক্কালে নিজের দেশ সহ বিশ্বের সকল নারিদের উদ্দেশ্যে গবেষক রিনা চক্রবর্তী বলেন, আপনারাও ’স্ট্রাগেল“ করুন। নিজেদের পায়ে দাঁড়ান।আন্তর্জাতিক নারী দিবস কে সামনে রেখে আমি সমস্ত নারীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই,’হার মানবেন না। নারীরা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শপথ নিন“।নারী দিবসে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হবে। ওই দিন সেখানে আমাকে সম্মানিত করবে বিভিন্ন শিক্ষা সংস্থা। মনে রাখবেন,“আমি স্ট্রাগেল করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে, আপনারাও নিজেদের এমন সন্মান প্রাপ্তির যোগ্য করে তুলতে পারবেন ।
আগামী পরিকল্পনা প্রসঙ্গে গবেষক রিনা চক্রবর্তী জানান ,“নিজের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে তিনি দিল্লীর নয়ডার মুরাদ নগরের অনতি দূরে ১৪ বিঘা জমি কিনেছেন।অল্প জায়গায় অল্প জলে বিজ্ঞান সন্মত ভাবে মাছ চাষ করে কিভাবে নিজের পায়ে দাঁড়ানো যায় ,তার ’রিসার্চ সেন্টার’ ওই জমিতে তিনি তৈরি করবেন।সেখানে মাছ চাষে উৎসাহী নারী ও পুরুষ সকলকে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এই কাজ কয়েক মাসের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে বলে রিনা চক্রবর্তী জানিয়েছেন।
প্রফেসর রিনা চক্রবর্তীর দাদা ডঃ দিলীপ চক্রবর্তী একদা ফইজাবাদ এগরিকালচারাল ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করতেন।সেখান থেকে অবসর নিয়ে এখন তিনি গ্রামের বাড়িতে রয়েছেন। সাথে সাথে বর্ধমান এগরিকালচারাল কলেজে ভিজিটিং প্রফেসার হিসাবে প্রফেসারি করছেন।’রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার তাঁরই সহপাঠী বলে দিলীপ চক্রবর্তী জানান। তিনি এও বলেন, “আমার বোন রিনা প্রাইমারি স্তর থেকে শুরু করে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত গ্রামের স্কুল অর্থাৎ শাঁকারী অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং শাঁকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে।বোন ১৯৭৬ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে। তারপর বর্ধমানের রাজ কলেজে ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালযের পাঠ সম্পূর্ণ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যা শাখার মৎস্য বিজ্ঞান বিষয়ে পিএইচডি সম্পূর্ণ করে। বোন বিয়ে করে নি।রিনা বর্তমানে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে মৎস্য বিজ্ঞান শাখার বিভাগীয় প্রধান পদে দায়িত্বে রয়েছে। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের ভাবাদর্শকে পাথেয় করে আমার বোন নারী শিক্ষায় অগ্রগতির দিশা দেখিয়ে চলেছে।“
পূর্ব বর্ধমান জেলাপরিষদের অধ্যক্ষ অপার্থিব ইসলাম হলেন খণ্ডঘোষের বাসিন্দা।রিনা চক্রবর্তীর সাফল্যে তিনিও যারপরনাই গর্বিত।অপার্থিব বাবু বলেন,’মাছ চাষে বাংলা প্রভূত উন্নতি করুক,মাছ উৎপাদনে বাংলা সম্বৃদ্ধ হোক,এটাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চান।আমি চাই আমাদের খণ্ডঘোষের শাঁখারীর রিনা চক্রবর্তী এই কাজে পাশে দাঁড়ান । তাঁতে মাছ চাষে বাংলায় নতুন দিগন্ত তৈরি হবে“।।
Bengali girl Rina’s research on fisheries science has received worldwide response; President honours her on the eve of Women’s Day