প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,৩১ মে : শ্রমিকের কাজ করতে বেঙ্গালুরু গিয়ে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ার ১০ মাস বাদ জেল থেকে মুক্তি পেলেন এই বাংলার এক দম্পতি। মা শুক্লা অধিকারী ও বাবা পলাশ অধিকারী সঙ্গে জেলেই দিন কাটছিল তাঁদের শিশু পুত্র আদির।আর দু’এক দিনের মধ্যে দম্পতি পলাশ ও শুক্লা তাঁদের শিশু পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে পূর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুর থানার জৌগ্রাম পঞ্চায়েতের তেলে গ্রামের ফিরবেন। বাড়িতে ফিরে তাঁরা পরিবারের সবার দেখা পাবে , কিন্তু পাবেন শুধু বাবা পঙ্কজ অধিকারীর দেখা।কারণ ছেলে, বৌমা ও নাতিকে ব্যাঙ্গালুরু জেল থেকে মুক্ত করার জন্য আইনি লড়াই লড়তে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া পঙ্কজবাবু অসুস্থ হয়ে পড়ে মাস দুই আগে মারা যান।পলাশ বাড়ি ফিরেই সম্পন্ন করবে তাঁর প্রয়াত পিতার পরলৌকিক কৃয়া কর্ম। তাই এখন ছেলে পলাশের জন্য পথ চেয়ে বসে আছে তাঁর মা ও বোনেরা।
জৌগ্রামের তেলে গ্রামে রয়েছে পলাশ দের টিনের চালার দু’কুঠুরি ভাঙাচোরা বাড়ি। ওই বাড়ি দেখলে যে কেউ বুঝে যাবেন দারিদ্রতাই অধিকারী পরিবারের নিত্যদিনের সঙ্গী।পলাশদের মতোই তাদের প্রতিবেশীরাও অত্যন্ত দরিদ্র।মাথা গোঁজার ঠাঁই টুকুই শুধুমাত্র তাদের সম্বল।তাদের বেশিরভাগ জনই দিন মজুরির কাজ করে অন্নের সংস্থান
করেন। বাকিদের কেউ বালাপোশ তৈরি,আবার কেউ বিড়ি বাঁধার কাজ করে উপার্জন করেন।
এমনই এক গ্রামের ছেলে পলাশ রোজগারের আশায় স্ত্রী ও শিশু পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে গত বছরের
জুন মাসে গিয়েছিলে বেঙ্গালুরু । কিন্তু উপার্জন করা তো দূরের কথা ,উল্টে সেখানে তাঁদের পরিণতি হয় ভয়ংকর।পলাশ অধিকারীর আত্মীয় পিন্টু হাওলাদার জানান,শ্রমিকের কাজ করে জন্য পলাশের সঙ্গেই বেঙ্গালুরু যায় তাঁর বাবা পঙ্কজ অধিকারী, মা সবিতাদেবী ও প্রতিবেশী সুনীল অধিকারী। সেখানকার মারাথাহাল্লি (Marathahalli) মহকুমার ভারথুর(varthur) থানার সুলিবেলে (sulibela) গ্রামের কায়েন খাঁনের ডেরায় তাঁরা সবাই ওঠে। দৈনিক ৩০০-৪০০ টাকা মজুরির শর্তে সেখানে তারা কায়েন খাঁনের অধীনে কাজ করা শুরু করেন।তাদের কাজ ছিল হোটেল,রেঁস্তোরা,সিনেমা হল সহ বিভিন্ন জয়গা থেকে সংগৃহীত বর্জ্যবস্তু, বোতল, প্লাস্টিক সরঞ্জাম এইসব বাছাই করা ।
পিন্টু হাওলাদারের কথায়,পলাশরা বেঙ্গালুরু যাবার পর প্রথম দিকে সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল ।হঠাৎ করেই ওই বছরের ২৭ জুলাই সেখানকার ভারথুর (varthur) থানার পুলিশ কায়েন খাঁনের ডেরায় হানা দেয়। সেখানে যাঁরা যাঁরা বাংলাভাষী ছিল তারা সবাই নাকি বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী সন্দেহে ভারথুর থানার পুলিশ পলাশদের ও আরো পাঁচ জনকে পাকড়াও করে থানায় নিয়ে যায়।ওই সময়ে পলাশ সহ তাঁর স্ত্রী,বাবা-মা ও প্রতিবেশী সুনীল অধিকারী ভারথুর থানার পুলিশকে জানান তাঁরা কেউই বাংলাদেশী নন। তাঁরা নিজেদেরকে ভারতীয় বলে জানিয়ে নিজের নিজের আধার কার্ড,প্যান কার্ড,ভোটার কার্ড সবই দেখান। সেইসব দেখে সেখানকার পুলিশ পলাশের বৃদ্ধ বাবা,মা ও প্রতিবেশী সুনীল অধিকারীকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে পলাশ এবং তাঁর স্ত্রী ও শিশুপুত্র ছাড়ে না । ভারথুর থানার পুলিশ বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী অভিযোগে তাদের গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়ে দেয়।সেই থেকে প্রায় ১০ মাস শিশু পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে পলাশ ও তাঁর স্ত্রী ব্যাঙ্গালুরুর জেলে চোখের জল ফেলেই দিন কাটায়।তার মধ্যে ভারথুন থানার পুলিশের তদন্তকারী দল তেলে গ্রামের বাড়িতে এসে সব কিছু দেখে পলাশদের ভারতীয় নাগরিকত্ব সংক্রান্ত সমস্ত নথি নিয়ে যায় । জামালপুর বিডিও অফিস , থানা ও জেলা প্রশাসন থেকেও বিভিন্ন নথি সংগ্রহ করে। তবুও পশাশদের জেল থেকে মুক্ত হয় না। পলাশদের জেল মুক্তির জন্য দীর্ঘ আইনি লড়াই চালাতে গিয়ে ওর বাবা ও মা কার্যত নিঃস্ব হয়ে যায় । অবশেষে গত ২৪ মে ব্যাঙ্গালুরু আদালত পলাশ ও তাঁর স্ত্রীর জামিন মঞ্জুর করে ।
পলাশের দুই বোন সাথী ও শম্পা এদিন বলেন,
আমার দাদা ,বৌদি ও ভাইপো ১০ মাস বাদে বেঙ্গালুরু জেল থেকে মুক্তি পেল ঠিকই। কিন্তু দাদা বৌদি ও ভাইপোর বাড়ি ফেরাটা বাবার আর দেখা হল না । চলতি বছরের ২৮ মার্চ বাবা পঙ্কজ অধিকারীর নিথর দেহ বেঙ্গালুরু থেকে তেলে গ্রামের বাড়িতে ফেরে । দাদা থেকে জেলবন্দি থাকায় আমরা দুই বোন মিলে বাবার অন্তেষ্টিকৃয়া সম্পাদন করি । কিন্তু দাদার অনুপস্থিতিতে থমকে ছিল বাবার পরলৌকিক কৃয়া কর্ম সম্পান। দাদা বাড়ি ফিরলে সেই কৃয়া কর্ম সম্পাদন হবে। আক্ষেপ প্রকাশ করে সাথী ও শম্পা এদিন বলেন, দাদা, বৌদি ও ভাইপোর বাড়ি ফেরার আনন্দের মধ্যেও বাবার জন্য বিষাদ রয়েই থাকবে ।
জৌগ্রাম পঞ্চায়েতের তেলে গ্রামের নির্বাচিত সদস্য কৃষ্ণা সরকার বলেন,’পলাশদের করুণ পরিণতি দেখে জৌগ্রাম এলাকার অন্য কেউ ভিন রাজ্যে কাজে যাওয়ার আর সাহস দেখাবে বলে মনে হয় না ।’ বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী অভিযোগে ভারতের এক রাজ্যের জেলে ভারতীয় নাগরিকের ১০ মাস বন্দি থাকাটা নজিরবিহীন বলে রেখাদেবী মন্তব্য করেছেন ।।

