প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,০৭ অক্টোবর : বন্যা রোখার জন্য নেওয়া হয়েছিল মুণ্ডেশ্বরী নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা।সেই মতই দু’বছর আগে ঢাক ঢোল পিটিয়ে মুণ্ডেশ্বরী নদীতে শুরু হয়েছিল ’জ্রেজিং’ এর কাজ।একই সাথে নদী ভাঙন রুখতে বোল্ডার দিয়ে দামোদর ও মুণ্ডেশ্বরী নদীর পাড় বাঁধানোর কাজও চলে।কাগজে কলমে বিশ্বব্যাঙ্কের আর্থিক সহায়তায় হওয়া এইসব কাজ সফলতা পেলেও কাজের কাজ যেন কিছুই হল না। আগের মত এবারও ডিভিসি’র ছাড়া জল মুণ্ডেশ্বরী ও দামোদর উপচেই প্রবাহিত হল।আর তার কারণে পুজোর মুখে বানভাসী হল পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর ব্লকের জ্যোৎশ্রীরাম অঞ্চলের বেশকিছু গ্রাম। তার দরুন হওয়া ক্ষয়ক্ষতি সামলাতে এখনও হিমসিম খাচ্ছেন ওইসব গ্রামের বাসিন্দারা। এমত অবস্থায় বিশ্বব্যাঙ্কের আর্থিক সহায়তায় হওয়া নদীর ’ড্রেজিং’ কাজের সার্থকতা নিয়েই শুরু হয়ে গিয়েছে আঙুল ওঠা।
কৃষি মাতৃক জেলা পূর্ব বর্ধমান।রাজ্যের শস্য গোলা হিসাবেও এই জেলার খ্যাতি রয়েছে।এমন এক জেলার জামালপুর সহ বিস্তির্ণ অংশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে দামোদর নদ । তারই শাখা নদী মুণ্ডেশ্বরী । সেই শাখা সৃষ্টির স্থান হিসাবে মান্যতা পেয়ে আসছে জামালপুর ব্লকের জ্যোৎশ্রীরাম অঞ্চলের মুইদিপুরের ’বেগোর মুখ’এলাকাটি।এখান থেকেই সৃষ্ট মুণ্ডেশ্বরী নদী হুগলীর দিকে বয়ে গিয়েছে।আর অন্য দিকে বয়ে গিয়েছে দামোদর। মুইদিপুরে ’বেগোর মুখের’ কাছে দামোদরের গা ঘেঁষে রয়েছে জ্যোৎশ্রীরাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত অমরপুর, পাইকপাড়া, পারউজিরপুর, শিয়ালী, কোরা,সাজেমলতলা প্রতৃতি গ্রাম।আর দামোদরের শাখা নদী মুণ্ডেশ্বরীর গা ঘেঁষে জ্যোৎশ্রীরাম অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে মাঠশিয়ালী, রেশেলাতপুর, মুইদিপুর ও উজিরপুর।এইসব গ্রাম গুলির অপর প্রান্তে মুণ্ডেশ্বরীর গা ঘেঁষে রয়েছে রায়না ২ ব্লকের গোতান, সুবলদহ, বড়বৈনান, বাতাসপুর, নরসিংহপুর, ফতেপুর প্রভৃতি গ্রাম।
পুজোর মুখে টানা কয়েক দিন ভারী বৃষ্টিপাত চলার মধ্যেই ডিভিসি জল ছাড়া শুরু করে। সেই জল দামোদর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বেগোর মুখ’এলাকায় পৌছাতেই জল দামোদর ও মুণ্ডেশ্বরী উপচে যায় । তার কারণে জ্যোৎশ্রীরাম অঞ্চলের বেশ কয়েকটি গ্রাম সহ রায়না-২ ব্লকের গোতান অঞ্চলের কয়েকটি গ্রামও বানভাসী হয়ে পড়ে ।
এই বন্যাকে ’ম্যান মেইড’ বন্যা বলে দাবি করে ক্ষোভ উগরে দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।বন্যায় মানুষের দুর্ভোগ বাড়ায় মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ১৯ সেপ্টেম্বর পূর্ব বর্ধমানের রায়না ২ ব্লক ও জামালপুরের বন্যা পরিস্থিতি সরজমিনে খতিয়ে দেখতে আসেন মন্ত্রী অরুপ বিশ্বাস। ওই দিনই রাজ্যের সেচ মন্ত্রী মানস ভুঁইঞা সহ রাজ্যের পাঁচ মন্ত্রী মিলে বন্যায় জেলার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে পর্যালোচনা বৈঠকও করেন।এর ঠিক তিন দিন পরেই বনা পরিস্থিতি নিয়ে বর্ধমানে প্রশাসনিক বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী।ওইদিন মুখ্যমন্ত্রী পুজোর সময় বাংলা বানভাসী হওয়ার জন্য ডিভিসি’র সাথে সাথে কেন্দ্রীয় সরকারকেও কাঠগড়ায় তোলেন।পাশাপাশি জলাধার গুলির ’ড্রেজিং’ কাজ না হওয়া নিয়েও তিনি ক্ষোভ ব্যক্ত করেন।
যদিও বানভাসী হওয়া জ্যোৎশ্রীরাম অঞ্চলের গ্রাম গুলির বাসিন্দারা বন্যা নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের এই কচকচানি নিয়ে মাথাই ঘামাতে চান নি।তাঁরা বরং ভিন্ন ’দোষারোপে’র’ কথাই সামনে এনেছেন।তাঁরা মূলত মণ্ডেশ্বরীর নাব্যতা বৃদ্ধি এবং বোল্ডার দিয়ে দামোদরের ’পাড়’ বাঁধানো কাজের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচের সার্থকতা কি হল , তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন।এমনকি ’বেগোর মুখ’ এলাকায় ড্রেজিং কাজ না হওয়ার পিছনে কারণ কি রয়েছে, তারও উত্তর তাঁরা পেতে চাইছেন ।
এমন প্রশ্ন তোলার পিছনে বানভাসী হওয়া মুণ্ডেশ্বরী লাগোয়া জ্যোৎশ্রীরাম অঞ্চলের গ্রাম গুলির বাসিন্দাদের ব্যাখ্যা ,’ডিভিসি জল ছাড়লে আগেও তাঁদের গ্রাম বানভাসী হত।এবারও একই ভাবে বানভাসী হল।তাহলে ’বেগোর মুখের’ পর থেকে মুণ্ডেশ্বরী নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি কাজের স্বার্থকতা কি মিললো? শুধু তাই নয়,জল কমার সাথে সাথে দামোদরের পাড়ের বেশ কিছু জায়গায় বোল্ডার পিচিং ধসে পড়া নিয়েও হতাশা ব্যক্ত করেছেন গ্রামবাসীরা।এ নিয়ে তাঁদের বক্তব্য,’অর্থ খরচের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজটা যাথাযথ ভাবে হলে ,হয়তো এমনটা হত না’।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া জ্যোৎশ্রীরাম অঞ্চলের বাসিন্দারের তোলা এইসব প্রশ্নের উত্তর পেতে সেচ দফতরের একাধীক জেলা আধিকারিকের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তাঁরা যদিও জানিয়ে দেন,’এ বিষয়ে তাঁদের কিছু জানা নেই।উত্তর পাওয়ার জন্য হাওড়া,হুগলী বা কলকাতার অফিসের সঙ্গে যোগযোগ করার পরামর্শও তাঁরা দেন।এর পর রাজ্যের সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইঞা কে ফোন করা হলে তিনি বলেন ,“এখনই আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না। প্রশ্ন গুলো আমাকে লিখে পাঠান।ডিপার্টমেন্টে গিয়ে কথাবলে জেনে তারপর উত্তর দেবেন বলে সেচ মন্ত্রী জানান। জেলাশাসক আয়েসা রানী এ অবশ্য নিজে রবিবার দামোদর পাড়ের বোল্ডার ধসে পড়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখেন। পরে তিনি বলেন ,’এই বিষয়টি নিয়ে আমি সেচ দফতরের সঙ্গে কথা বলবো।’।