কোচবিহারের ধানতলা, হুগলির সিঙ্গুর, পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার মত জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন নব্বইয়ের দশকে সিপিএমের শাসনকালে শিউরে ওঠার মতো ঘটনা হল দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার বানতলা গনধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ৷ যা নাড়িয়ে দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সহ গোটা দেশের মানুষকে ৷ ১৯৯০ সালের ৩০ মে বানতলায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রক ও ইউনিসেফের ২ জন মহিলা আধিকারিককে গনধর্ষণ করা হয় । নির্মমভাবে হত্যা করা আরও একজন আধিকারিক ও তাদের গাড়ির চালককে । ওই নরপশুদের নৃশংসতা এখানেই থেমে থাকেনি । গনধর্ষণের পর এক মহিলার যোনীতে নরপশুরা ধাতব টর্চ ঢুকিয়ে দিয়েছিল । এমনকি নিগৃহীতার চিকিৎসা করতে গিয়ে যৌনাঙ্গে ধাতব টর্চ দেখে অজ্ঞান হয়ে যান একজন মহিলা চিকিৎসক। কিন্তু সিপিএমের জমানায় সেই সময় এতটাই নৈরাজ্য ছিল যে এতবড় নৃশংসতার পরেও প্রমাণের অভাব, আর রাজনৈতিক চাপে সঠিক বিচার পায় না এই ধর্ষণ কাণ্ডের মূলে থাকা আসল অপরাধীরা। বানতলা ধর্ষণ কাণ্ডের ফাইল চাপা পড়ে যায় । এই ঘটনার পর তোলপাড়ের মাঝে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছিলেন,’এমন তো কতই হয় ।’ তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রশান্ত শূরের প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘গ্রামবাসীরা মহিলা আধিকারিকদের শিশুপাচারকারী মনে করে আক্রমণ করেছিল।’
ত্রিপুরার প্রাক্তন রাজ্যপাল তথাগত রায় এক্স-এ লিখেছেন,’যেন ভুলে না যাই। আজ ছিল বানতলা গণধর্ষণ ও গণহত্যাকান্ডের বার্ষিকী। ১৯৯০ সালে এই দিনটিতে কিছু সিপিএম সমর্থক একটি সরকারি গাড়ি থেকে উমা ঘোষ,রেণু ঘোষ ও অনিতা দেওয়ান নামক তিন মহিলা অফিসারকে নামিয়ে ধর্ষণ ও হত্যা করে। এঁদের ড্রাইভার অবনী নাইয়াকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় এবং তার পুরুষাঙ্গ ছেঁচে দেওয়া হয়। এঁদের ময়না তদন্তকারী ডাক্তার, যাঁরা যথেষ্ট পোড়-খাওয়া মানুষ, এর বীভৎসতাতে অজ্ঞান হয়ে যান। এই ঘটনায় শয়তান জ্যোতি বসুর প্রতিক্রিয়া ছিল, “এরকম তো কতই হয়”! আজকের সেলিম-মীনাক্ষীর সিপিএম কিন্তু এর থেকে আলাদা কিছু নয়। এদের মেধাবী ছাত্রী মমতার কীর্তি দেখে এদের কথা কিন্তু ভুলে যাবেন না।’
ঠিক কি ঘটেছিল সেদিন ?
উইকিপিডিয়া থেকে যেটা জানা যাচ্ছে যে ১৯৯০ সালের ৩০ মে গোসাবায় একটি টীকাকরণ কর্মসূচি সেরে তিন জন স্বাস্থ্য আধিকারিকের একটি দল কলকাতায় ফিরছিলেন। এই দলে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অতিরিক্ত জেলা গণমাধ্যম বিভাগের উপ-আধিকারিক অনিতা দেওয়ান, স্বাস্থ্য মন্ত্রকের উচ্চপদস্থ আধিকারিক উমা ঘোষ এবং ইউনিসেফের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন দিল্লি কার্যালয়ের প্রতিনিধি রেণু ঘোষ। সন্ধ্যা সাড়ে ছটা নাগাদ যখন তারা ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসের কাছে বানতলায় পৌঁছান তখন ৪-৫ জন যুবক স্থানীয় ক্লাবের কাছে তাদের গাড়ি থামাতে বাধ্য করে। গাড়ির চালক অবনী নাইয়া তাদের পাশ কাটিয়ে গাড়ি নিয়ে পালাতে গেলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়িটি উলটে যায়। এই সময় আরও ১০-১২ জনের একটি দল সেখানে উপস্থিত হয়। তারা গাড়ির একজন আধিকারিককে টেনে বার করে। আগের দলটি অন্য দুই আধিকারিককে বার করে । গাড়ির চালক তাদের বাধা দিতে যান, কিন্তু ব্যর্থ হন। দলটি গাড়ির চালককে হত্যা করার চেষ্টা করে এবং গাড়িটিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। দুই মহিলা আধিকারিকদের কাছের একটি ধানক্ষেতে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করা হয়। একজন আধিকারিক তাদের বাধা দিতে যান। ধর্ষকরা তাকে হত্যা করে।
রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ পুলিশ গিয়ে গনধর্ষিতা মহিলা আধিকারিকদের নগ্ন দেহ উদ্ধার করে। তাদের ক্যালকাটা ন্যাশানাল মেডিক্যাল কলেজের আপদকালীন বিভাগে ভর্তি করা হয়ে। প্রথম দিকে তাদের মৃত মনে করা হয়ে হয়েছিল। কিন্তু দুজন বেঁচে ছিলেন। তাদের চিকিৎসা শুরু হয়। একজন মহিলা ডাক্তার জনৈক আধিকারিকের যোনিতে একটি ধাতব টর্চ দেখে অজ্ঞান হয়ে যান। আহত ড্রাইভার অবনী নাইয়াকে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার দেহে ধারাল অস্ত্রের ৪৩টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। আক্রমণকারীরা তার পুরুষাঙ্গটি পিষে দিয়েছিল। ১৯৯০ সালের ৪ জুন, সকাল ৫টা ৪০ মিনিটে তিনি মারা যান। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের প্রশিক্ষণরত স্বাস্থ্য আধিকারিক ডাঃ বিশ্বনাথ কাহালি তার অটপসি করেছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রশান্ত সুর ধর্ষকদের পক্ষ নিয়ে বলেছিলেন, তারা মহিলা আধিকারিকদের ওই দলটিকে শিশুপাচারকারী মনে করে আক্রমণ করেছিল। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এই ঘটনা সম্পর্কে বলেছিলেন, ধর্ষণের ঘটনা খুবই স্বাভাবিক। বানতলা গণধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা অবলম্বনে একটা ছবিও পরবর্তী কালে তৈরি হয়েছিল । কিংশুক দে পরিচালিত সেই ছবির নাম ‘দ্য রেড ফাইলস’ । ছবিতে অভিনয় করেছিলেন কিঞ্জল নন্দ, জুঁই সরকার, তানিশকা রায়, অভীরূপ চৌধুরী, সঞ্জীব ঘোষ, দেবপ্রসাদ হালদার ছাড়াও অনেকে।
প্রায় সাড়ে তিন দশকে সিপিএমের শাসনে পশ্চিমবঙ্গে নৈরাজ্যের খতিয়ান ও বানতলা গণধর্ষণ-হত্যার কারন :
প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে সিপিএমের শাসনে পশ্চিমবঙ্গে নৈরাজ্যের চিত্র একটা তুলে ধরেছিলেন জনৈক ডি. বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক ব্যক্তি । তিনি প্রাক্তন রাজস্ব সচিব এবং ভারত সরকারের পল্লী উন্নয়ন সচিব। তিনি ২০১০ সালের ১৪ অক্টোবর একটি প্রতিবেদনে লিখেছিলেন,সিপিআই-এম নামক ফ্যাসিবাদী মাফিয়া গোষ্ঠীর শাসিত রাজ্যে বাস করা কতটা যন্ত্রণাদায়ক তা কেউ জানে না। এই গোষ্ঠী ১৯৭৭ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে ৫৫,৪০৮টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এর অর্থ হল, প্রতিদিন প্রতি চার ঘন্টা ৫০ মিনিটে একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। শাসক মাফিয়া গোষ্ঠীর মতামত ছাড়া কেউ নিরাপদ নয়। তাদের সম্মিলিত নেতৃত্ব নির্মম, লোভী এবং নির্দয় ডনের একটি দল ছাড়া আর কিছুই নয়।
চাঁদাবাজি, অবৈধ চাঁদাবাজি এবং ঘুষ ছাড়াও তাদের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস হল নারী পাচার। ভারতের অপরাধ ব্যুরো অনুসারে, ২০০২ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে ৬০,০০০ নারী এবং কিশোরী মেয়েদের মুনাফার জন্য বিক্রি করা হয়েছিল। এটি ভারতের সমস্ত রাজ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যা। এটি অনুমান করা হয়েছিল – এবং এটি কলকাতার একটি বাংলা দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছিল – এই হিসাবে লাভের পরিমাণ ছিল ১৩৬০ কোটি টাকা। সিপিআই-এম-এর মহিলা সংগঠনের চেয়ারপার্সন নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে কলকাতার একজন সত্তা ডনের মাধ্যমে এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন। বোম্বে বিস্ফোরণের পরপরই ডনের গুদামে বিস্ফোরণ ছাড়া এটি আর কখনও বের হত না। এর ফলে আলমারি থেকে কঙ্কাল বেরিয়ে আসে।
আশির দশকের গোড়ার দিকে, সিপিআই-এম ধর্ষণকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে যুক্ত করেছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইউনিসেফের একজন কর্মকর্তা মিসেস অনিতা দেওয়ান দক্ষিণ ২৪ পরগনার কিছু সিপিআই-এম-নিয়ন্ত্রিত পঞ্চায়েতে ইউনিসেফের তহবিল সংক্রান্ত একটি বিশাল জালিয়াতি সনাক্ত করেন। তিনি যখন কিছু বাজেয়াপ্ত করা অপরাধমূলক নথিপত্র নিয়ে ফিরে আসছিলেন, তখন বানতলায় তার গাড়িটি বাধাগ্রস্ত হয়। গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। চালককে হত্যা করা হয়। এবং মিসেস দেওয়ানকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়। তার নগ্ন দেহ ধানক্ষেতে ফেলে দেওয়া হয়। ঘটনাটি যখন রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কাছে জানানো হয়, তখন তার রহস্যময় এবং নিন্দনীয় মন্তব্য ছিল : “এই ধরনের ঘটনা ঘটে, তাই না?” এইভাবে তিনি সিপিআই-এমের রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ধর্ষণকে অনুমোদন দেন। তার উত্তরসূরী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রামে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেন। ১৫ জুলাই, ২০১০ তারিখে বিধানসভার এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন যে ২০০৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে ২৫১৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এক বছরের পরিসংখ্যান কোনও প্রবণতা নির্দেশ করে না। তবে এটি আমাদের অনুমানমূলক প্রবণতার পরিসংখ্যানের ভিত্তি দিতে পারে। ধরে নিই যে বছরে গড়ে ২৪০০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, ২০০৬ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে মোট ধর্ষণের সংখ্যা হবে ৯৬০০। এর অর্থ হল মাসে গড়ে ২০০টি ধর্ষণের ঘটনা। এর অর্থ দৈনিক গড়ে ৬.৬। এর অর্থ হল প্রতি চার ঘন্টায় একটি ধর্ষণ সংঘটিত হয়। পশ্চিমবঙ্গে কোনও স্বাধীনচেতা মহিলা নিরাপদ নন।।