এইদিন ওয়েবডেস্ক,বাংলাদেশ,২০ ডিসেম্বর : সহকর্মী চিকিৎসকের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস ছিল রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ শাহীন শাহের। বিশ্বাস করে কার্ডিওলজি বিভাগের সহকর্মী সিনিয়র কনসালটেন্ট ডাঃ মাহবুবুর রহমানের অধীনে নিজের মেশোমশাই রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার আব্দুল্লাহপুর গ্রামের বাসিন্দা আফজাল হোসেনকে (৬৫) হাসপাতালে ভর্তি করান তিনি। স্বাভাবিক অবস্থায় থাকা আফজাল হোসেনকে এনজিওগ্রাম করে রক্তনালীতে রিং (স্টেন্ট) পরাতে গিয়ে তা ছিদ্র করে ফেলেন ডাঃ মাহবুবুর রহমান। গত বছরের ৭ নভেম্বর এনজিওগ্রাম করে রিং লাগাতে গিয়ে হার্টের রক্তানালী ছিদ্র হওয়ায় রক্তক্ষরণে কয়েক ঘণ্টা পর মারা যান আফজাল হোসেন। বিষয়টি এখন প্রকাশ্যে আসছে । একজন চিকিৎসক এবং ক্যাথল্যাবে (যেখানে রিং পরানো হয়) কর্মরত সিনিয়র স্টাফ নার্সের মধ্যে কথোপকথনে ওই চিকিৎসকের অযোগ্যতায় একজন রোগীর বেঘোরে প্রাণ চলে যাওয়ার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে । ডাঃ .মাহবুবুর রহমানের রিং পরানো সম্পর্কিত সেই অডিও ক্লিপ সাংবাদিকের হাতে আসার পরেই শোড়গোল পড়ে গেছে ।
চিকিৎসক হয়ে হৃৎযন্ত্রের রিং (স্টেন্ট) বিক্রি করেন, হৃৎযন্ত্রের রক্তনালীতে একটি রিং পরিয়ে তিনটির টাকা নেন, রক্তনালীতে ব্লক না থাকলেও ব্লক আছে বলে আতঙ্কিত করে তোলেন- এমন সব অভিযোগের সঙ্গে আফজাল হোসেনসহ আরেকজন রোগীর মৃত্যুর লিখিত অভিযোগের মুখে এখন ডাঃ মাহবুবুর রহমান।
ওই অডিও ক্লিপে একজন চিকিৎসক সিনিয়র ওই স্টাফ নার্সের কাছে জানতে চান কীভাবে গত ৭ নভেম্বর ডাঃ মাহবুবুর রহমানের অধীনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আফজাল হোসেন মারা যান। উত্তরে ওই নার্স জানান,ওইদিন ডাঃ মাহবুব পাঁচটি এনজিওগ্রাম করার পর দুপুরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও প্রস্তুতি ছাড়াই আফজাল হোসেনকে ক্যাথল্যাবে নিয়ে এসে এনজিওগ্রাম করান। এনজিওগ্রামে হার্টের একটি রক্তনালী সম্পূর্ণভাবে ব্লক ছিল এবং ডাঃ মাহবুব সেটাতে রিং পরানোর জন্য ওইদিন দুপুর দেড়টায় ক্যাথল্যাবে কর্মরত নার্স ও টেকনিশিয়ান খোরশেদকে তাগাদা দেন। সম্পূর্ণভাবে ব্লক রক্তনালীতে রিং পরাতে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করলে ডাঃ মাহবুব ক্ষিপ্ত হয়ে ওই নার্সকে ‘বকাঝকা’ করেন। ওই বন্ধ রক্তনালীতে একটার পর একটা রিং লাগানো ওয়্যার ও বেলুন ঢুকিয়ে সম্পূর্ণরুপে বন্ধ রক্তনালী খুলতে চেষ্টা করেন। ফলে রক্তনালী ফেটে যায়।
ওই নার্স বলেন, পরবর্তীতে ওই রোগীকে সিসিইউতে নিয়ে কোনো ধরনের সুরক্ষা ছাড়াই রোগীর হৃৎযন্ত্রের ভেতর থেকে রক্ত বের করে ওই রোগীর হাতে লাগানো ক্যানোলা দিয়ে সেই রক্ত রোগীর শরীরে প্রবেশ করাতে থাকেন ডাঃ মাহবুব। ফলে রোগী মারা যান।
কথোপকথনে ওই নার্স বলেন, ডাঃ মাহবুব প্রতিটি এনজিওগ্রামে ব্যবহৃত নিডিল, ক্যাথেটার, এক্সটেনশন টিউব তার নিকট থেকে কিনতে বাধ্য করেন এবং ৫০০-৬০০ টাকার জিনিস আড়াই হাজার থেকে ৩,০০০ টাকায় বিক্রি করেন। প্রতিটি এনজিওগ্রাম থেকে তিনি তিন থেকে চার হাজার টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করেন। ওইদিন পাঁচটি এনজিওগ্রাম করে ২০ হাজার টাকা অবৈধ আয় করেন।
নার্স এক পর্যায়ে ডাঃ মাহবুবকে ‘কসাই’ বলেও অবিহিত করেন। ওই নার্স আরও বলেন, প্রতিটি এনজিওগ্রাম করে রোগীকে এনজিওগ্রামের টেবিলে রেখে ডাঃ মাহবুবের ক্যাথল্যাবের ভেতরের নিজের রুমে রোগীর লোককে ডেকে মৃত্যু ভয় দেখিয়ে রিং লাগানোর জন্য আতঙ্কিত করেন। তিনি নিজেই অবৈধভাবে রিং বিক্রি করেন কিন্তু টাকা গ্রহণের রিসিপ সরবরাহ করেন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কার্ডিওলজিস্ট জানান, রক্তনালী সম্পূর্ণরুপে ব্লক থাকলে অত্যাধুনিক ও উন্নত যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়, যেটা রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেই। অথচ ডাঃ মাহবুব জোর করে রিং ওয়্যার ও বেলুন ঢোকানোর কারণে রক্তনালী ফেটে যায়। এরপর মাহবুব ক্যাথল্যাবের কার্যক্রম বন্ধ করে রেজিস্ট্রার খাতায় ইংরেজিতে ‘Cancelled’ লিখে আফজালের মৃত্যুর দায় এড়ানোর চেষ্টা করেন। রেজিস্ট্রার খাতার এই দুইটি কপিও এখন সাংবাদিকদের হাতে।
এই ঘটনায় গত ৭ ডিসেম্বর রমেক হাসপাতালের পরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন একই হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ শাহিন শাহ। গত বছরের ৭ নভেম্বর ডাঃ মাহবুবের অধীনে রিং পরানোর পর মারা যান ডাঃ শাহিন শাহের মেসোমশাই আফজাল হোসেন (৬৫)।
অন্যদিকে ডাঃ মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে হার্টের রক্তনালীতে রিং পরিয়ে ভুল চিকিৎসা ও অবহেলায় স্বামী লাল মিয়া (৫০) মারা যাওয়ার অভিযোগে ৮ নভেম্বর আরেকটি লিখিত অভিযোগ করেন গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার কচুয়া গুজাপাড়া গ্রামের মোসা ফরিদা বেগম। ২১ সেপ্টেম্বর ডাঃ মাহবুবের দ্বারা প্রতারণার শিকার বদরগঞ্জের মাসুমা বেগমের ছেলে মোহা মশিউর রহমান লিখিত অভিযোগ করেন যে, হৃৎযন্ত্রের রক্তনালীতে ব্লক না থেকেও ব্লক আছে এমন প্রতারণা করার জন্য। ২৩ নভেম্বর গাইবান্ধার ভুক্তভোগী আতোয়ার রহমানও ডা. মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন একটি রিং পরিয়ে তিনটির টাকা নেওয়ার।
এদিকে ডাঃ মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে গত ৭ ডিসেম্বর তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কমিটিতে কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান ডাঃ হরিপদ সরকারকে সভাপতি ও হাসপাতালের উপপরিচালক আখতারুজ্জামানকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। এতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইদুজ্জামান। ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
গত ৮ ডিসেম্বর তদন্ত কমিটির সভাপতি ও বিভাগীয় প্রধান ডাঃ হরিপদ সরকার স্বাক্ষরিত (স্মারক নং-২০২৪/১২/০৮/০১) পত্রে ‘ক্যাথল্যাবে অনিয়ম সংক্রান্ত অভিযোগের প্রেক্ষিতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ সংক্রান্ত’ বিষয়ে বক্তব্য ও ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে ডাঃ মাহবুবুর রহমানকে লিখিতভাবে তলব করেছেন।
হাসপাতালের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক ও নার্সরা ডাঃ মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে রিং ও অন্যান্য সরঞ্জমাদি বিক্রির অভিযোগ মৌখিকভাবে অবগত করলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগসহ হাসপাতালের প্রাক্তন পরিচালক কোনো ব্যবস্থা নেননি। বরং তদন্ত কার্যক্রম শুরুর পর অবৈধ আয়ের কারবার ফাঁস হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ডাঃ মাহবুবুর রহমান। নিজের দোষ ঢাকতে মরিয়া হয়ে ওঠা এই চিকিৎসক বিভিন্ন মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের ম্যানেজ করার প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হন।।এরপরই স্থানীয় ও ঢাকা থেকে প্রকাশিত দুটি গণমাধ্যমের প্রিন্ট ও অনলাইন সংস্করণে ডা: মাহবুবুর রহমানের ‘সাফল্য’ তুলে ধরে সংবাদ প্রকাশিত হয়। যাতে দীর্ঘ ছয় বছর ধরে হাসপাতালের বন্ধ থাকা ক্যাথল্যাবটি মাহবুবুর রহমানের প্রচেষ্টায় চালু এবং হার্টে রিং স্থাপনসহ অন্যান্য কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে দাবি করা হয়। তদন্ত কার্যক্রম চলাকালে তদন্ত প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা থেকে এমন সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীসহ সচেতন মহল।
তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ১০ ও ১১ ডিসেম্বর প্রকাশিত সংবাদটিতে নতুন কোনো তথ্য নেই। বরং আট মাস আগে মার্চ মাসে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ক্যাথল্যাব চালুর সংবাদটি হুবহু প্রকাশ করা হয়। যেখানে শুধুমাত্র পূর্বের পরিচালকের নামের জায়গায় পরিবর্তন করে লেখা হয়েছে বলে একজন ডাক্তার জানান। সচেতন মহলের দাবি, নিজের অপকর্ম ঢাকতে সাফল্যের ঢোল পেটাতে গিয়েও ভুল করেছেন ডাঃ মাহবুবুর রহমান। এখন প্রশ্ন উঠছে, ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধি করতেই কী মাহবুবুর রহমান ক্যাথল্যাব চালুর উদ্যোগ নেন?
অন্যদিকে ডাঃ মাহবুবুর রহমান তার চেম্বারের সামনে বিভিন্ন ডিগ্রি উল্লেখ করে আগের টাঙানো নেমপ্লেট সরিয়ে নিয়েছেন। সেখানে এখন শুধু নিজের নাম ও পদবি উল্লেখ করে নতুন নেমপ্লেট টাঙানো হয়েছে। হঠাৎ দীর্ঘদিন ধরে টাঙানো নেমপ্লেট পরিবর্তন করায় তার ডিগ্রি নিয়েও নানান প্রশ্ন উঠেছে সাধারণ রোগী, ভুক্তভোগী ও সচেতন মহলের মাঝে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও রমেক হাসপাতাল পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক দপ্তরে ডাঃ মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে রিং বাণিজ্যসহ প্রতারণার একাধিক অভিযোগ দায়ের করেছেন ভুক্তভোগীরা।
এদিকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ডাঃ মাহবুবুর রহমান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, প্রত্যেকটা রোগীর হার্টে রিং স্থাপনের পর তাকে রিপোর্ট কপি এবং সিডি দেওয়া হয়। সেখানে বিস্তারিত তথ্য থাকে। এরপরও যদি কেউ অভিযোগ করে তাহলে এটা দুঃখজনক।
তিনি আরও বলেন, সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হার্টে রিং বসানো বা স্থাপন এবং এনজিওগ্রাম খরচ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় কম হওয়ায় কিছু সিন্ডিকেট ও কুচক্রী মহল রোগীর স্বজনকে ভুল বুঝিয়ে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন। কোনো অর্থনৈতিক লেনদেনের সঙ্গে জড়িত নন বলেও দাবি করেন এই চিকিৎসক।।