এইদিন স্পোর্টস নিউজ,২৩ জুলাই : লিটন কুমার দাসের নেতৃত্বে প্রথম টি-টোয়েন্টি সিরিজে পাকিস্তানকে ধরাশায়ী করল বাংলাদেশ ৷ ঢাকার মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে বাংলাদেশের বিমানবাহিনীর চীনা জঙ্গি বিমান বিধ্বস্তে বহু হতাহতের ঘটনার পর ম্যাচটি শুরু হয়েছিল প্রবল শোকের আবহে। ক্রিকেটীয় লড়াইয়ে দাপুটে শুরুর পর শেষ দিকে রোমাঞ্চের ছড়িয়ে শেষ পর্যন্ত জিতল বাংলাদেশ। নিশ্চিত হলো সিরিজের ট্রফিও। বহু কাঙ্ক্ষিত এই সাফল্য মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির শিকার সবার উদ্দেশে উৎসর্গ করলেন লিটন কুমার দাস।
সোমবার দুপুরে মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনার পরপরই সামাজিক মাধ্যমে সহমর্মিতা ও শোক প্রকাশ করেন লিটন কুমার দাস । মাঠের লড়াইয়ে শোককে শক্তিতে পরিণত করে তার দল । ১৩৩ রানের পুঁজি নিয়ে ৮ রানের জয়ে বাংলাদেশ পায় পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের স্বাদ। ম্যাচ শেষে পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে ক্রিকেটীয় নানা প্রশ্নের পর নিজ থেকেই সঞ্চালকের কাছে সময় চেয়ে নেন লিটন। পরে মাইলস্টোনের দুর্ঘটনায় আক্রান্ত সবার জন্য সিরিজ জয়টি উৎসর্গ করেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।
“আমরা জানি, গতকাল যে দুর্ঘটনাটা ঘটেছে, পুরো বাংলাদেশ জাতির জন্য হৃদয়বিদারক। এই সিরিজ জয়টি সম্পূর্ণ তাদের। আমরা জানি, যাদের (স্বজন মারা) গিয়েছে তাদের শূন্যতা কিছু দিয়ে পূরণ করতে পারব না। তবে অন্তত আমাদের পক্ষ থেকে, এই সিরিজ জয়টি তাদের জন্য।”
মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে জাকের আলির লড়াকু ৫০-এ মঙ্গলবার ২০ ওভারে বাংলাদেশ তোলে ১৩৩ রান। সেই রান তাড়ায় ৪৭ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকে পাকিস্তান। কিন্তু ফাহিম আশরাফের ব্যাটিংয়ে অভাবনীয় এক জয়ের সম্ভাবনা জাগায় তারা। তবে শেষ পর্যন্ত শেষ ওভারের ফয়সালায় সমর্থকদের হতাশ করেনি লিটনের দল।
উইকেট আগের ম্যাচের মতোই ছিল অনেকটা মন্থর। বল থমকে এসেছে কিছুটা, বাউন্স ছিল অসমান। তার পরও ১৩৪ রানের লক্ষ্য নাগালের বাইরে ছিল না। কিন্তু সেই লক্ষ্যই ভীষণ দুরূহ হয়ে ওঠে বাংলাদেশের দুর্দান্ত বোলিংয়ে।প্রথম উইকেটটি ছিল উপহার। প্রথম ওভারেই রান আউট সাইম আইয়ুব। এরপর যেন বয়ে যায় উইকেট-প্রপাত। তাসকিন আহমেদের বিশ্রামে একাদশে ফেরা শরিফুল ইসলামের শিকার মোহাম্মাদ হারিস ও ফাখার জামান। তানজিম হাসানের দুর্দান্ত দুটি ডেলিভারিতে পরপর দুই বলে শূন্যতে শেষ হাসান নাওয়াজ ও মোহাম্মাদ নাওয়াজ।
পঞ্চম ওভারেই ১৫ রানে তখন ৫ উইকেট নেই পাকিস্তানের! এই সংস্করণে এত কম রানে ৫ উইকেট হারানোর নজির তাদের আর নেই। বাংলাদেশেরও এত কম রানে ৫ উইকেট অর্জনের কীর্তি এটি প্রথম।এরপর উইকেটের মিছিলে কিছুটা বিরতি। তবে স্বস্তি ফেরেনি পাকিস্তানের। অধিনায়ক সালমান আলি আগার (২৩ বলে ৯) রানের যন্ত্রণাময় উপস্থিতি শেষ করেন মেহেদি। পাকিস্তানের প্রথম ছয় ব্যাটসম্যানের সম্মিলিত রান ১৮!
একটু পর মেহেদি ফিরিয়ে দেন খুশদিল শাহকেও (১৩)।পাকিস্তানের রান তখন ৭ উইকেটে ৪৭। তাদের সর্বনিম্ন দলীয় রান কত, বাংলাদেশের বিপক্ষে কোন দলের স্কোর সবচেয়ে কম, নানা পরিসংখ্যানের খোঁজাখুঁজি তখন চলছে। কিন্তু সেই ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়েও জয়ের ছবি আঁকছিলেন ফাহিম আশরাফ। দারুণ পাল্টা আক্রমণে তিনি এগিয়ে নেন দলকে। সঙ্গী পান আব্বাস আফ্রিদিকে (১৩ বলে ১৯)। দুজনের ২৭ বলে ৪১ রানের জুটিতে জেগে ওঠে পাকিস্তানের মৃতপ্রায় আশা। বাংলাদেশের বোলিং- ফিল্ডিংও কিছুটা আলগা হয়ে পড়ে তখন।
এরপর অভিষিক্ত আহমেদ দানিয়ালকে (১১ বলে ১৭ অপরাজিত) নিয়ে এগোতে থাকেন ফাহিম। শেষ দুই ওভারে পাকিস্তানের প্রয়োজন পড়ে ২৮ রানের। ১৯তম ওভারে রিশাদ হোসেনকে তিন বলের মধ্যে দুটি চার মারেন দানিয়াল, পঞ্চম বলটি ছক্কায় উড়িয়ে দেন ফাহিম।পাকিস্তানের জিততে লাগে তখন ৭ বলে ১৩ রান!
কিন্তু ক্যারিয়ার-সেরা ইনিংস খেলেও শেষ পর্যন্ত পেরে ওঠেননি ফাহিম (৩২ বলে ৫১)। ওভারের শেষ বলে রিশাদের জোরের ওপর করা ডেলিভারিতে বোল্ড হয়ে যান তিনি। শেষ ওভারে ১৩ রানের সমীকরণে মুস্তাফিজের প্রথম বলে চার মেরে দেন দানিয়াল। পরের বলে উড়িয়ে মারেন তিনি ছক্কার চেষ্টায়, মিড উইকেট সীমানায় বল মুঠোয় জমান শামীম। জয়ের গর্জন ওঠে গ্যালারিতে।
ম্যাচের প্রথম ভাগে টস হেরে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশ দ্বিতীয় ওভারে হারায় মোহাম্মদ নাঈম শেখকে (৭ বলে ৩)। তানজিদ হাসানের বদলে একাদশে জায়গা পাওয়া ব্যাটসম্যান উইকেট হারান কিপারের ওপর দিয়ে বল পাঠানোর চেষ্টায়।ফাহিম আশরাফের টানা দুই বলে পারভেজ হোসেন ইমনের ছক্কা ও চারে ছিল পাল্টা আক্রমণের ইঙ্গিত। কিন্তু সেই হাওয়া পাল্টে যায় দ্রুতই। ৬ রানে জীবন পাওয়া লিটন কুমার দাস ৮ রানেই বিদায় নেন পুল খেলে। ওই ওভারেই তাওহিদ হৃদয়ের (০) রান আউট ছিল যেন আত্মহত্যা।
পরের ওভারে পারভেজও (১৪ বলে ১৩) যখন ফিরলেন আলতো ক্যাচ দিয়ে, ২৮ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে তখন ভেঙে পড়ার অপেক্ষায় বাংলাদেশের ইনিংস। নড়বড়ে দেয়ালকে পতন থেকে রক্ষা করেন জাকের আলি ও শেখ মেহেদি হাসান। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাটিং যেন প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন মেহেদি। সবশেষ পাঁচ টি-টোয়েন্টি ইনিংসে তার মোট রান ছিল ১৭। অবশেষে এ দিন দুটি করে চার-ছক্কায় ২৫ বলে ৩৩ রান করেন তিনি। তার ৬০ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস এটি। পঞ্চম উইকেট জুটিতে রান আসে ৫৩।
এরপর শামীম হোসেন (১) ও তানজিম হাসানের (৭) দ্রুত বিদায়ে আবার পথচ্যুত হয় ইনিংস। সেখান থেকে দলকে ১৩০ পার করানোর কৃতিত্ব বলতে গেলে জাকেরের একার। বেশ কিছু ডেলিভারিতে তিনি রান নিতে পারেননি, কয়েকটি ডেলিভারিতে রান নেননি স্ট্রাইক ধরে রাখতে। সব পুষিয়ে দেন তিনি পাঁচটি ছক্কায়। ৩২ রানে জীবন পাওয়াটাও কাজে লাগান তিনি।
শেষ ওভারে আব্বাস আফ্রিদিকে দুটি ছক্কায় স্পর্শ করেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তার তৃতীয় ফিফটি। আগের ম্যাচে ভালো বোলিং করা সালমান মির্জা এই ম্যাচেও দারুণ বোলিংয়ে নেন দুটি উইকেট, অভিষিক্ত পেসার আহমেদ দানিয়েলের প্রাপ্তিও দুটি।
তখনও পর্যন্ত পাকিস্তানের সম্ভাবনা জিইয়ে ছিল ভালোভাবেই। একটু পরই তা পরিণত হয় ধ্বংস্তুপে। এরপর লড়াই জমে ওঠে বটে, কিন্তু ম্যাচের ভাগ্যে বদল আসেনি। এই মাঠেই বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ নামবে হোয়াইটওয়াশ সাফল্যের আশায়।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১৩৩ (নাঈম ৩, পারভেজ ১৩, লিটন ৮, হৃদয় ০, জাকের ৫৫, মেহেদি ৩৩, শামীম ১, তানজিম ৭, রিশাদ ৮, শরিফুল ১, মুস্তাফিজ ০*; সালমান মির্জা ৪-১-১৭-২, ফাহিম ৩-০-২০-১, দানিয়াল ৪-০-২৩-২, মোহাম্মাদ নাওয়াজ ৩-০-১৯-১, সাইম ১-০-৩-০, খুশদিল ১-০-১২-০, আফ্রিদি ৪-০-৩৭-২)।
পাকিস্তান: ১৯.২ ওভারে ১২৫ (ফাখার ৮, সাইম ১, হারিস ০, সালমান আলি আগা ৯, হাসান নাওয়াজ ০, মোহাম্মাদ নাওয়াজ ০, খুশদিল ১৩, ফাহিম ৫১, আফ্রিদি ১৯, দানিয়াল ১৭, সালমান মির্জা ০*; মেহেদি ৪-০-২৫-২, শরিফুল ৪-০-১৭-৩, মুস্তাফিজ ৩.২-০-১৫-১, তানজিম ৪-০-২৩-২, রিশাদ ৪-০-৪২-১)।