প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৭ সেপ্টেম্বর : হিন্দুরা বিষ্ণুর সপ্তম অবতার রামচন্দ্র কে দেবতা হিসাবেই মেনে থাকেন।রাবণকে বধ করার জন্য সেই রামচন্দ্র অকালে ১০৮টি নীল পদ্ম দিয়ে দেবী দুর্গার পুজো করে ছিলেন। সেই থেকে আজও দুর্গা পুজোয় দেবীর চরণে ১০৮ টি পদ্ম নিবেদন করার রীতি চালু আছে।এই রীতিতে ছেদ পড়ুক,তা সম্প্রীতির বাংলায় বসবাস করা হিন্দুরা যেমন চান না,তেমনই মুসলিম ধর্মাবলম্বীরাও হয়তো চান না।তাই লাভ লোকসানের কোনও প্রত্যাশা না করেই বছরের পর বছর ধরে শেখ বাবর পদ্ম ফুলের চাষ করে যাচ্ছেন।তাঁর চাষ করা পদ্মে এ বছরও দেবী মহামায়া বাংলার বিভিন্ন মণ্ডপে পূজিত হবেন।
এই বাবর অবশ্য মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর নন। দুর্গা পুজোর জন্য পদ্মফুল চাষ করে চলা শেখ বাবর হলেন একজন চাষি।তিনি পূর্ব বর্ধমানের খণ্ডঘোষ ব্লকের বেরুগ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত কালনা গ্রামের বাসিন্দা।তাঁর দাদা পদ্মফুল চাষ করা শুরু করেছিলেন।দাদা মারা যাবার পর বাবর পদ্ম ফুলের চাষ বন্ধ করে দেন নি।বরং তিনি তাঁর দাদার দেখানো পথেই পদ্ম চাষের হাল ধরেন।সেই থেকে প্রায় তিরিশ বছরেরও বেশী সময় কাল ধরে তিন পদ্ম ফুল চাষ করে চলেছেন।
শেখ বাবর বলেন,’পুজারি ব্রাহ্মনের কাছে শুনেছি দুর্গা পুজোয় পদ্মফুলের গুরুত্ব অনেক। আমার এলাকার হিন্দু ধর্মের মানুষজন দুর্গা পুজোর সময় আমার কাছ থেকে পদ্ম ফুল পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকেন।পুজোর পদ্ম ফুল না পেলে তারা ব্যাথিত হন। সেটা আমার খুবই খারাপ লাগে ।তাই লাভ লোসানের প্রত্যাশা না করেই আমি পদ্ম চাষ টাকে ধরে রেখেছি।’ বাবর এও জানান,খণ্ডঘোষ ব্লকে পদ্ম ফুল চাষের উপযোগী জলাশয়ের অভাব নেই ।তাই তিনি তাঁর লোকজন নিয়ে চৈত্র মাস থেকে জলাশয় পরিষ্কার করে পদ্ম চাষে লেগে পড়েন।সার সহ বিভিন্ন ওষুধপাতি যথাযথ ভাবে ব্যবহার করে তিনি জলাশয়কে পদ্ম চাষের উপযোগী করে তোলেন।এর জন্য সরকারী কোনও সুবিধা না পেলেও নিখুঁত পরিচর্যা চালিয়েই তিনি পদ্ম ফুল উৎপাদন করেন।কার্তিক মাস পর্যন্ত তিনি যথাযথ ভাবে পদ্ম ফুলের যোগান দিয়ে যেতে পারেন বলে জানিয়েছেন ।
হিন্দুদের সবথেকে বড় পার্বণ দুর্গা পুজো । দেবী দুর্গার পুজোয় হিন্দুদের ভক্তি ভাবের কোন অন্ত থাকে না।সেই দেবী দুর্গা এবছরও সেখ বাবরের চাষ করা পদ্মফুলে পূজিত হবেন।পুজারির মাধ্যমে দেবীর চরণে নিবেদিত হবে বাবরের নিজের চাষ করা পদ্ম ফুল ।এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে শেখ
বাবর একটু আবেগ প্রবন হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমার চাষ করা পদ্ম ফুল দেবী দুর্গার চরণে দিয়ে পুজোপাঠ হয়,এতে অসুবিধার কি আছে! আমার তো ভালোই লাগে।আমি মুসলিম সম্প্রদায়ের একজন মানুষ হওয়া সত্ত্বেও আমার চাষকরা পদ্ম ফুলে দুর্গা ঠাকুরের পুছো হয় , এটাই বড় কথা ।এর জন্য অনেকে আমাকে ভক্তি করে,ভালোও বাসেন ।’
হিন্দু পুজারী স্বপন চট্টোপাধ্যায় বলেন,’দেবী দুর্গা মায়ের পুজো হয় সবার মঙ্গল কামনায় ।সেই মঙ্গল কামনায় জাত ধর্মের কোন ভেদাবেদ থাকে না। কারণ দেবীর কাছে সকল মানুষই সমান ।হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী ’নর-ই নারায়ন’। পদ্মফুল চাষী সেখ বাবরও একজন ’নর’ অর্থাৎ মানুষ । এটাই তাঁর বড় পরিচয়। স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ মুসলিম কন্যাকে কুমারী জ্ঞানে পুজো করেছিলেন। কাজেই বাবরের চাষকরা পদ্ম ফুলও দেবীর পুজোয় সমান মূল্যবান। ‘ এটাই দুর্গা মায়ের পুজোর বড় স্বার্থকতা বলে পুজারী স্বপন চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন।।