প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,২৫ নভেম্বর : ওভারলোড বালির লরি যাতায়াত বন্ধে প্রশাসনকে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । কিন্তু বাস্তবে পূর্ব বর্ধমানে চলছে ঠিক তার উল্টোটাই। এখন সন্ধ্যা নামলেই জেলার প্রায় প্রতিটি সড়ক পথে শুরু হয়ে যাচ্ছে ওভারলোড বালির লরির অবাধ যাতায়াত । এমনকি চালান না থাকা অবৈধ ওভারলোড বালি বোঝাই লরির চালকরাও বুক ফুলিয়ে সড়ক পথ ধরে যাতায়াত করছে। বুধবার রাতে জেলার জামালপুর থানার বেরুগ্রাম অঞ্চলের রাস্তা দিয়ে বিনা চালানে লরিতে অবৈধ ভাবে ওভার লোড বালি নিয়ে যাওয়ার সময়ে সদর্পে সেই কথা সংবাদ মাধ্যমের ক্যামেরার মুখোমুখি হয়ে জানিয়েও দেয় দুই লরি চালক । এত কিছুর পরেও পুলিশ এবং ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতর কেন নিরব সেই প্রশ্নই সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ঘুরপাক খাচ্ছে ।
অন্য দিনের মত বুধবার রাতেও ওভারলোড বালি বোঝাই লরি একের পর এক যাওয়া শুরু করে জামালপুরের বেরুগ্রাম অঞ্চলের রাস্তা দিয়ে। সদ্য তৈরি হওয়া এলাকার পাকা রাস্তা দিয়ে অতিমাত্রায় ওভারলোড বালি বোঝাই লরি, ডাম্পার গিয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দেখে এলাকার বাসিন্দারা ওইসব লরি দাঁড় করিয়ে প্রতিবাদ জানান । সেই খবর পেয়ে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরাও ঘটনাস্থলে পৌছে যায় । সেখানেই সাংবাদিকের ক্যামেরার মুখোমুখি হন বিনা চালানের ওভারলোড বালি বোঝাই একটি লরির চালক শুভজিৎ ঘোষ ওরফে বগু। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন,তাঁর কাছে বালি বহন সংক্রান্ত কোন চালান নেই । রায়নার নতু এলাকার খাদান থেকে তিনি তাঁর লরিতে বালি লোড করেছেন বলে জানান। কোথায় ওই বালি নিয়ে যেতে হবে তাও তিনি জানেন না বলেন ।পাশাপাশি লরিতে ওভার লোড বালি থাকার কথা স্বীকার করে নিয়ে তিনি দাবি করেন, ‘এখন সবাই এই ভাবেই লরিতে বালি লোড করে নিয়ে যাচ্ছে ।তাই তিনিও যাচ্ছেন ।’
চালান না থাকলেও পুলিশ তাঁর বালির লরি ধরে না । এ পরেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে লরি চালক শুভজিৎ বলেন, ‘চালান নেই তো, পুলিশ ধরুক । পুলিশ ধরছে কই’। অপর আর এক বালি বোঝাই লরির চালক জানান, তাঁর নাম সাহেব পণ্ডিত। জামালপুরের মসাগ্রামে তিনি থাকেন বলে জানান । একই সঙ্গে তিনিও তাঁর লরিতে ওভারলোড বালি থাকার কথা স্বীকার করে নিয়ে বলেন বালি বহনের চালান তাঁর কাছেও নেই । বালি বোঝাই লরি নিয়ে কলকাতায় যাবেন । তবে বালির চালান তাঁর লরির মালিকের কাছে আছে বলে সাহেব পণ্ডিত দাবি করেন। গ্রামবাসীরা প্রতিবাদ জানিয়ে চলে যাবার পর লরি চালকরা একের পর এক বেরুগ্রাম অঞ্চল থেকে বেরিয়ে এসে জামালপুরের হরেকৃষ্ণ কোঙার সেতু পেরিয়ে চলে যায় ।
এই ঘটনা জানতে পারার পরেই জামালপুর ও রায়না থানার পুলিশ বিনা চালানে চলাচল করা ও ওভারলোড বালির গাড়ি ধরার অভিযানে নামে । রাতেই পুলিশ শুভজিৎ ঘোষের বালির লরিটি ধরে ফেলে । জামালপুরের মসাগ্রাম নিবাসী শুভজিৎকে পুলিশ গ্রেপ্তারও করে । একই রাতে রায়না থানার পুলিশ অভিযানে নেমে দুটি বালির লরি ধরে । বালি বহন সংক্রান্থ বৈধ চালান দেখাতে না পারায় পুলিশ ওই বালির লরিগুলির চালক চাঁদু মাঝি ও মিঠুন সিংকে গ্রেপ্তার করে । পুলিশ জানিয়েছে , চাঁদুর বাড়ি খণ্ডঘোষের সালুনে । অপর ধৃত মিঠুনের বাড়ি বর্ধমানের সদরঘাট এলাকায় । সুনির্দিষ্ট ধারায় মামলা রুজু করে পুলিশ তিন ধৃতকেই এদিন পেশ করে বর্ধমান আদালতে ।
সন্ধ্যা নামলেই ওভারলোড বালির লরির বেপরোয়া যাতায়াত নিয়ে বিগত কয়েকদিন ধরেই সরব রয়েছেন জামালপুরের জ্যোৎশ্রীরাম পঞ্চায়েতের মুইদিপুর গ্রামের বাসিন্দারা । গত বছর এই গ্রামের বাঁধের রাস্তা থেকে গৃহস্থের বাড়িতে ওভার লোড বালি বোঝাই লরি উল্টে পড়ায় একই পরিবারের তিন সদস্যের মৃত্যু হয় । এই বছরও বালি খাদান চালু হওয়ার পর থেকে একই ভাবে রাতে ওভার লোড বালি বোঝাই লরির দৌরাত্ম্য বাড়ায় রাতের ঘুম ছুটে গিয়েছে মুইদিপুর গ্রামের বাসিন্দাদের । বেরুগ্রাম অঞ্চলের বাসিন্দারা এদিন অভিযোগে বলেন,’তাঁদের এলাকার পাকা পিচ রাস্তা তৈরির করা সবে মাত্র শেষ হয়েছে । এখন প্রত্যেকদিন সন্ধ্যা নামলেই ওই সড়কপথ দিয়ে শয়ে শয়ে ওভারলোড বালি বোঝাই ট্রাক ও ডাম্পার যাতায়াত করছে । তার কারণে কয়েক কোটি টাকা ব্যায়ে নতুন করে তৈরি হওয়া রাস্তার ব্যাপক ক্ষতি হয়ে গিয়েছে । অথচ সব দেখেও নিরব থাকছে পুলিশ ও ভূমি দপ্তর ।’এইভাবে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যক্তি মুনাফা লুটলেও বিপুল পরিমান রাজস্ব লাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে রাজ্য সরকার বলে বেরুগ্রামের বাসিন্দারা মন্তব্য করেছেন ।
ওভারলোড বালির লরি চলাচল নিয়ে ক্ষোভ বিক্ষোভ তৈরি হওয়ার কথা জানতে পারার
পরেই বৃহস্পতিবার নড়ে চড়ে বসে জেলার পুলিশ ও প্রশাসন । জানা গিয়েছে,এদিন অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ) ও জেলার পুলিশ সুপার বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন । কেন রায়না থেকে জামালপুর হয়ে ওভারলোড বালির লরি যাচ্ছে তা নিয়ে দু’জনের মধ্যে কথা হয় । পুলিশের দাবি, গত দু’দিনে ১১ টি ওভার লোডেড বালির গাড়ি ধরা হয়েছে। তার মধ্যে তিনটি গাড়ি থেকে পুলিশ ভূয়ো বালির চাালান পেয়েছে । ওভার লোডের জন্য পুলিশ ফাইনও করে । এদিন জামালপুর,রায়না ও খণ্ডঘোষ থানার ওসিদের নিয়ে বৈঠক করে পুলিশ সুপার কড়া বার্তা দিয়ে দিয়েছেন,যাতে করে বালি সংক্রান্ত কোন অভিযোগ আর না আসে । সরকারি নির্দেশ মেনে বালি ঘাটগুলি চলছে কিনা সেই বিষয়ে সবিস্তার তথ্য সংগ্রহের কথা ওসিদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে ।
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে ,সরকারী খাতায় কলমে পূর্ব বর্ধমান জেলায় ২২৪টি বালি খাদান রয়েছে। তার মধ্যে ৩৫ টি খাদান রয়েছে জামালপুর ব্লকে ।জামালপুরের বিএলআর অফিসের সন্নিকটে একটি খাদান বেআইনি ভাবে চলার খবর ইতিমধ্যেই জেলা প্রশাসনের কাছে পৌঁছেচে । যন্ত্রের সাহায্যে ওই খাদান থেকে বালি তোলা হচ্ছে জানার পর ভূমি দফতর ওই বেআইনি খাদান বন্ধ করানোর নির্দেশ দিয়েছে বলেও জানা গিয়েছে ।
অতিরিক্ত জেলা শাসক ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়
এদিন জানিয়েছেন,বালি থেকে চলতি নভেম্বর মাসে (বুধবার পর্যন্ত )৪ কোটির বেশী টাকা আদায় হয়েছে। রাজস্ব আদায়ে গোটা রাজ্যের মধ্যে পূর্ব বর্ধমান সব থেকে এগিয়ে বলে দাবি করেছেন অতিরিক্ত জেলাশাসক ।।