এইদিন ওয়েবডেস্ক,নয়াদিল্লি,০৯ ফেব্রুয়ারী : দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল আম আদমি পার্টির শোচনীয় পরাজয় হয়েছে । এমনকি এএপি সুপ্রীমো অরবিন্দ কেজরিওয়াল পর্যন্ত হেরে গেছেন। ফলে অবসান ঘটেছে এএপির ১০ বছরের শাসনের । দিল্লি বিধানসভার ৭০টি আসনের মধ্যে এএপি পেয়েছে মাত্র ২২টি । যেখানে বিজেপি পেয়েছে ৩৮ টি আসন । কংগ্রেস দিল্লি থেকে কার্যত সাফ হয়ে গেছে । কিন্তু অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দলের এই শোচনীয় পরাজয়ের পিছনে কারন কি ? অভিজ্ঞ মহলের মতে সীমাহীন দুর্নীতির পাশাপাশি মুসলিম তোষামোদি রাজনীতি কেজরিওয়ালের ভরাডুবি ডেকে এনেছে । তাদের মতে ভোটব্যাঙ্ক বাড়াতে বাংলাদেশি রোহিঙ্গা কলোনি গড়ে তাদের ভোটার কার্ড করে দেওয়াকে দিল্লির হিন্দুরা সহজভাবে নেয়নি । তারা প্রতিনিয়ত নিরাপত্তার অভাব অনুভব করছিল । যার প্রভাব ইভিএমে পড়েছে । দিল্লির হিন্দু মহিলারা পর্যন্ত একাট্টা হয়ে যান কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে ।
অন্যদিকে এএপির মুসলিম ভোটব্যাংকে থাবা বসিয়েছে কংগ্রেস ও এআইএমআইএম । যেকারণে বিজেপির জয়ের পথ প্রশস্ত হয়ে গেছে ৷ আর এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হল দিল্লির মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা মুস্তাফাবাদ বিধানসভা । আসনটি জিতেছে বিজেপির একজন প্রার্থী ৷ মুস্তাফাবাদে, বিজেপি প্রার্থী মোহন সিং বিষ্ট আপের আদিল আহমেদকে পরাজিত করেছেন। মোহন সিং বিষ্ট ৮৫ হাজারেরও বেশি ভোট পেয়েছেন। তিনি আদিল আহমেদকে ১৭ হাজার ভোটে পরাজিত করেছেন। এই আসনে দিল্লি দাঙ্গার মূল হোতা তাহির হুসেনকে টিকিটও দিয়েছিল আসাদউদ্দিন ওয়াসি । তার দল অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমীন( AIMIM) টিকিটে লড়াই করেছিল তাহির । এই আসনে তাহির হুসেন ৩৩ হাজার ভোট পেয়েছেন। যেখানে এই আসনে কংগ্রেস পেয়েছে ১১,৭৬৩ ভোট। মুস্তাফাবাদ বিধানসভা নির্বাচনের গণনার কোনও রাউন্ডেই পিছিয়ে থাকেননি মোহন সিং বিষ্ট। মুস্তাফাবাদ হল সেই একই বিধানসভা কেন্দ্র যা ২০২০ সালে দিল্লিতে হিন্দু বিরোধী দাঙ্গার সময় মারাত্মক ভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।
মোহন সিং বিষ্ট বিজেপির একজন পুরনো এবং বড় নেতা। তিনি ১৯৯০ সাল থেকে দিল্লির রাজনীতিতে সক্রিয়। ১৯৯৮ সালে বিজেপির টিকিটে কারাওয়াল নগর থেকে বিষ্ট প্রথমবারের মতো বিধায়ক হন। তিনি ২০১৫ সাল পর্যন্ত এই আসন থেকে একটানা বিধায়ক ছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি এএপি প্রার্থীর কাছে হেরে যান। ২০২০ সালে, তিনি কারাওয়াল নগর থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হন। তিনি এখানে দুর্গেশ পাঠককে পরাজিত করেন। ২০২৫ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি মোহন সিং বিষ্টের আসন পরিবর্তন করে। বিজেপি কারাওয়াল নগর আসন থেকে হিন্দু ভাবমূর্তিসম্পন্ন নেতা কপিল মিশ্রকে প্রার্থী করেছিল।
মোহন সিং বিষ্টকে মুস্তাফাবাদ আসন থেকে প্রার্থী করা হয়েছিল। মুসলিম অধ্যুষিত আসন হওয়া সত্ত্বেও তিনি এখানে জিতেছেন। এখানকার প্রায় ৪৫% ভোটার মুসলিম। মনে করা হচ্ছে যে মুসলিম ভোট কংগ্রেস, আপ এবং এআইএমআইএম-এর মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে,যেকারণে মোহন সিং বিষ্ট আরও বেশি ভোটে জিততে সক্ষম হয়েছেন ।
অন্যদিকে দুর্নীতি, মুসলিম তোষামোদি রাজনীতির কারনে হিন্দু অধ্যুষিত আসনে লড়েও পরাজয়ের মুখ দেখতে হয়েছে অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও মণীশ সিসোদিয়াকে । দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং আপ প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল নয়াদিল্লি বিধানসভা আসন থেকে নির্বাচনে হেরে গেছেন। তিনি বিজেপির প্রবেশ সাহেব সিং ভার্মার কাছে পরাজিত হয়েছেন। ভোট গণনার সময় অরবিন্দ কেজরিওয়াল ক্রমাগত পিছিয়ে ছিলেন। এই আসনে কংগ্রেসের সন্দীপ দীক্ষিত তৃতীয় স্থানে ছিলেন।
এছাড়াও, দিল্লির প্রাক্তন উপ-মুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়াও হেরে গেছেন। তিনি জঙ্গপুরা থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। তিনি বিজেপির তরবিন্দর সিং মারওয়াহর কাছে পরাজিত হয়েছেন। মারওয়াহ সিসোদিয়াকে প্রায় ৬০০ ভোটে পরাজিত করেন। মনীশ সিসোদিয়া তার পরাজয় মেনে নিয়েছেন। সিসোদিয়া পাটপরগঞ্জ আসন ছেড়ে এখানে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে এসেছিলেন ।
তবে আম আদমি পার্টির (এএপি) জেতা ২২টি আসনের মধ্যে ১৪টি আসন রয়েছে যেখানে দলিত এবং মুসলিম ভোটারদের প্রাধান্য । বলা হচ্ছে যে এই সম্প্রদায়গুলি এখনো এএপি-কে সমর্থন করে চলেছে।ইন্ডিয়া টুডে দিল্লির ১৯টি বিধানসভা আসন পর্যালোচনা করেছে। এই আসনগুলিকে এএপি-এর শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত । এই ১৯টি বিধানসভা কেন্দ্রেই দলিত এবং মুসলিম ভোটারদের সংখ্যা ভালো। প্রতিবেদন অনুসারে, নির্বাচনে এই আসনগুলিতে এএপি-এর স্ট্রাইক রেট ছিল ৭৫ শতাংশ। গতবার আম আদমি পার্টি এই ১৯টি আসনের সবকটিই জিতেছিল। দলটি এবারের নির্বাচনে হেরেছে ঠিকই, কিন্তু এই আসনগুলি তাদের বিশাল ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করেছে।
তবে, ভোটের শতাংশের দিক থেকে এএপির উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে । এই আসনগুলিতে ভোটের শতাংশ কমেছে। অনেক আসনে এএপি ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এর ফলে, আম আদমি পার্টিকে চারটি এসসি সংরক্ষিত আসনে পরাজয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। দিল্লিতে ১২টি সংরক্ষিত আসনের মধ্যে দলটি মাত্র ৮টিতে জিততে পারে। এখানে এএপি-এর ভোটের হার কমেছে।
এখন দলিত-মুসলিম অধ্যুষিত কিছু আসনের ফলাফলের দিকে নজর দেওয়া যাক । যেখানে গত নির্বাচনের তুলনায় এ বছর এএপি-এর ভোটের শতাংশ কমেছে।
সীমাপুরী: প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে, আপ প্রার্থী ৬৫.৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। যা ২০২৫ সালের নির্বাচনে ৪৮.৪ শতাংশে কমেছে।
প্যাটেল নগর: এখানে দলের ভোটের শতাংশ ৬০.৮% থেকে কমে ৪৯% হয়েছে। ইতিমধ্যে, বাওয়ানা, মাদিপুর, মঙ্গোলপুরী এবং ত্রিলোকপুরী আসনগুলি আপের হাত থেকে চলে যায়। এগুলো সবই ছিল এসসি সংরক্ষিত আসন।
বাওয়ানা: আপের ভোটের ভাগ ৪৮.৪% থেকে কমে ৩৮.৩%, বিজেপির ভোটের হার ১০%।
কারোল বাগ: ভোট ৬২.২% থেকে কমে ৫০.৮% হয়েছে।
মঙ্গোলপুরী: আপ ১৩% ভোট হারিয়েছে, বিজেপি গতবারের তুলনায় ১৬% বেশি ভোট পেয়েছে।
ত্রিলোকপুরী: আপ ৬ শতাংশ ভোট হারিয়েছে।বিজেপির ভোট ৩% বৃদ্ধি পেয়েছে।
মাদিপুর: আপের ভোট ৫৬% থেকে কমে ৩৬%, বিজেপি এবং কংগ্রেসের ভোট বেড়েছে ১০%।
প্রতিবেদন অনুসারে, দিল্লির সাতটি মুসলিম অধ্যুষিত আসনেও এএপি-এর ভোটের ভাগ কমেছে। তবে, দলটি এই আসনগুলির মধ্যে ৬টি জিততে সক্ষম হয়েছে।
মুস্তাফাবাদ: এএপি এই আসনটি হেরেছে। ২০২০ সালে, এটি ৫৩.২% ভোট পেয়েছিল, যা এখন ৩৩% এ নেমে এসেছে। এবার এআইএমআইএম ১৬.৬% ভোট পেয়েছে এবং কংগ্রেস ৬% ভোট পেয়েছে।
ওখলা: মুসলিম ভোট তিন ভাগে বিভক্ত ছিল, তবুও আপ জিতেছে। মাতিয়া মহল, বল্লিমারান এবং চাঁদনী চক: আপ এই আসনগুলিতে জিতেছে, কিন্তু কংগ্রেস এখানে তাদের ভোট ৬-১১% বৃদ্ধি করেছে।
সিলামপুর: আপের ভোট ৩% বেড়েছে, কংগ্রেসেরও একই ক্ষতি হয়েছে।।

