উত্তরপ্রদেশের সমাজবাদী পার্টির এক সময়ের সুপ্রীমো মুলায়ম সিং যাদব ভারতের অন্যতম এক বিতর্কিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ৷ করসেবকদের উপর গুলি চালানোর নির্দেশ তাকে আরও বিতর্কিত চরিত্র করে তুলেছিল । তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা আর সমাজতন্ত্রের নামে মুসলিম তোষামোদ করে ভোটব্যাংকের ঘৃণ্য রাজনীতি করার অভিযোগ ওঠে উত্তরপ্রদেশে দীর্ঘ সময় ধরে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলানো মৃত মুলায়মের বিরুদ্ধে । তবে তার থেকেও নৃশংস ‘খুনি খেলা’ উত্তরপ্রদেশের মুজাফফরনগরের রামপুর তিরহার ঘটনায় খেলেছিলেন মুলায়েম সিং যাদব ৷ মুলায়েম সরকারের পুলিশের গুলিতে শত শত নিরস্ত্র মানুষ নিহত হয়েছিল, কিন্তু সরকার দাবি করে যে মাত্র ৭ জন মারা গেছে । গনধর্ষিতা হয়েছিল বহু নারী । এখনো বহু নরনারীর কোনো হদিশ পাওয়া যায়ন । সেই নৃশংস বর্বরোচিত ঘটনাকে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের মতোই বাস্তবায়িত করেছিল মুলায়েম সিং এর পুলিশ । রামপুর তিরহার ঘটনা জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের চেয়ে কম ভয়াবহ ছিল না। জানুন সেই ইতিহাস সম্পর্কে :-
সময়টা ছিল ১৯৯৪ সালের ২ অক্টোবর । গান্ধী জয়ন্তী দিবসে উত্তরাখণ্ডের একদল রাজ্য কর্মী বাসে করে নয়াদিল্লির বোট ক্লাবে পৃথক উত্তরাখণ্ডের দাবির সমর্থনে একটি ধর্না অনুষ্ঠানের জন্য যাচ্ছিলেন। উত্তরাখণ্ড রাজ্য কর্মীদের দিল্লি পৌঁছাতে বাধা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা পুলিশ বাহিনী তাদের থামিয়ে দেয়।
উত্তরাখণ্ড সংগ্রাম সমিতি ১৯৯৪ সালের ২রা অক্টোবর দিল্লিতে একটি সমাবেশের আয়োজন করেছিল এবং পাহাড়ি অঞ্চল থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ সমাবেশে অংশগ্রহণের জন্য বাসে করে দিল্লি যাচ্ছিল। ১৯৯৪ সালের ১ অক্টোবর রাত থেকে ২ অক্টোবর সকাল পর্যন্ত, পুলিশ আন্দোলনকারীদের উপর লাঠিচার্জ এবং গুলি চালায় ৷গান্ধী জয়ন্তীর সকালে পুলিশের গুলিতে সাতজন আন্দোলনকারী নিহত হন (পুলিশের পরিসংখ্যান অনুসারে) । গুলি চালানোর সময়, মাঠে দৌড়াদৌড়ি করা মহিলাদের মর্যাদা লঙ্ঘিত হয়েছিল। তাদের সম্মান লুণ্ঠন করা হয়েছিল।পয়লা অক্টোবর রাতে আন্দোলনকারীরা মুজাফফরনগরের রামপুর তিরহার কাছে পৌঁছালে পুলিশ তাদের আটক করে এবং হেফাজতে নেয়। মোট ৩৪৫ জন কর্মীকে আটক করা হয় এবং তাদের মধ্যে ৪৭ জন মহিলা ছিলেন যাদের বিরুদ্ধে পুলিশ ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ এনেছিল।
১৯৯৪ সালের ২রা অক্টোবরের রাতটি উত্তরাখণ্ডের মানুষের জন্য একটি অন্ধকার রাত হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিল। যখন শত শত বিক্ষোভকারী পৃথক রাজ্যের দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে দিল্লি যাচ্ছিল। এই বিক্ষোভকারীরা মুজাফফরনগরের রামপুর তিরহায় পৌঁছানোর সাথে সাথেই উত্তর প্রদেশের তৎকালীন মুলায়ম সিং সরকারের একগুঁয়েমির কারণে পুলিশ প্রশাসন বিক্ষোভকারীদের উপর তাণ্ডব চালায়।
যেখানে ৭ জন বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ। নরসানে বিক্ষোভকারীদের থামিয়ে দেয় পুলিশ । বিক্ষোভকারী রামলাল খান্ডুরি বলেছিলেন যে পয়লা অক্টোবর মধ্যরাত থেকে পুলিশ নরসান থেকে বিক্ষোভকারীদের যানবাহন থামাতে শুরু করে। তিনিও মুজাফফরনগরে পৌঁছাতে পারেননি।
মুজাফফরনগরের রামপুর মোড়ে মুলায়েমের পুলিশ সেই রাতে যে তাণ্ডব চালিয়েছিল আজ পর্যন্ত কোনও উত্তরাখণ্ডবাসী ১৯৯৪ সালের ১ অক্টোবরের সেই অন্ধকার রাত ভুলতে পারেনি। তার ক্ষত এখনও সেরে ওঠেনি । পৃথক রাজ্যের দাবিতে দিল্লিতে যাওয়া বিক্ষোভকারীদের বেছে বেছে লক্ষ্যবস্তু করেছিল পুলিশ। এই ভয়াবহ দৃশ্যটি জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের মতোই বাস্তবায়িত হয়েছিল। আর সবচেয়ে লজ্জাজনক ও অমানবিক ঘটনাটি ঘটে যখন গুলি চালানোর পর, পুলিশ এবং সমাজবাদী পার্টির কর্মীরা একসাথে শত শত মহিলার উপর গণধর্ষণের লজ্জাজনক কাজটি করে।
পৃথক রাজ্যের দাবিতে যন্তর মন্তরে প্রতিবাদ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। গাড়োয়াল এবং কুমায়ুন থেকে ২০০ টিরও বেশি বাস দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়, কিন্তু উত্তরপ্রদেশ সরকার বিক্ষোভকারীদের আর এগোতে দেয়নি এবং রামপুর তিরহায় কনভয়টি থামিয়ে দেয়। রামপুরা তিরহায় পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে উপস্থিত পুলিশ প্রশাসন বিক্ষোভকারীদের উপর লাঠিচার্জ ও এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। এই গুলিবর্ষণে ৭ জন বিক্ষোভকারী নিহত এবং ১৭ জন বিক্ষোভকারী আহত হন। আজও এই ঘটনায় বিপুল সংখ্যক মানুষ নিখোঁজ রয়েছে। আপনারা সেই রাতের ঘটনার কথা স্মরণ করলে শিহরিত হবেন । তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদবের বিরুদ্ধে এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড চালানোর অভিযোগ আনা হয়।
মুজাফফরনগর জেলার রামপুর তিরহায় উত্তরাখণ্ডের মহিলাদের উপর অত্যাচারের তিন দশক পর, অবশেষে ২০২৪ সালে দুই অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে সাজা দেওয়া হয় । রামপুর তিরহা ঘটনার সাথে সম্পর্কিত একটি মামলায় আজ মুজাফফরনগর (ইউপি) এর অতিরিক্ত দায়রা জজের ট্রায়াল কোর্ট পিএসি-র দুই অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা মিলাপ সিং এবং বীরেন্দ্র প্রতাপকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং প্রত্যেককে ১ লক্ষ টাকা জরিমানা করে । এই দুই অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে ১৫ মার্চ আদালত ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৬ (২) (জি), ৩৯২, ৩৫৪ এবং ৫০৯ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে এবং আজ এই সাজা ঘোষণা করে। ট্রায়াল কোর্ট স্পষ্ট করে দিয়েছে যে জরিমানার পুরো অর্থ দোষী সাব্যস্তদের কাছ থেকে আদায় করা হবে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের প্রদান করা হবে। কিন্তু এই নারকীয় ঘটনার প্রধান হোতা উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মুলায়েম সিং যাদবের কেউ টিকিও ছুঁতে পারেনি । জাতীয় রাজনীতিতে তার এতটাই প্রভাব ছিল । অথচ আজও মানুষ মুলায়েমের দল সমাজবাদী পার্টির হয়ে গলা ফাটায় । এটা দেশের জন্য দুর্ভাগ্য ।।