প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,২৫ আক্টোবর : নীলকন্ঠ পাখি উড়ে গেছে। পতিগৃহ কৈলাশে রওনা দিয়ে দিয়েছেন ঘরের মেয়ে উমা। তাই দর্পনেও বিষাদের ছায়া বাঙালির মনে।তবুই তারই মধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে বিজয়ার শুভকামনা জানাবার পালা। যুগের ধর্ম মেনে এখন তা মূঠোফোন বাহিত। তা কি যায় আসে , বারো মাসে তের পার্বণ পালনে কোন ছেদ টানার কথাই ভাবতে পারে না কোন বাঙালি ।তাই হয়তো ’৪ জি’ ছাপিয়ে ’৫ জি’ নেটওয়ার্কে সক্রিয়তা প্রদর্শন করে চলা মুঠো ফোন বুকে আগলে রেখেই নানা রিচ্যুয়াল পালন করে যাচ্ছে বাঙালি।
তেমনই একটি রিচ্যুয়াল হল বিজয়া দশমীতে দেবী বিসর্জনের পর রাতে সিদ্ধিদাতা গনেশের পুজো পাঠের মধ্যদিয়ে সাংসারিক সমৃদ্ধি কামনা করা। এ এক বিশেষ পুজো পাঠ। বহু যুগ আগে ওপার বাংলা হতে এপার বাংলায় যা বয়ে এনেছে এক ভিন্ন বার্তা। একসময়ের সমৃদ্ধ গ্রামবাংলার বুকের ভিতর আগলে রাখা ভালবাসা।
পূর্ব বঙ্গের বরিশাল জেলার বর্ণহিন্দু পরিবার বিজয়া দশমীর রাতে এই রিচ্যুয়াল পালন করে থাকেন। দেশ ভাগের পর সব হারিয়ে এ পাড়ের মরমী মানুষদের পাশে পেয়ে যাঁরা আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তাঁরা সেই রিচ্যুয়াল পালনে বিরাম টানেন নি । টানতেও চান না। শিকড়ের টানে অনেক পরিবার আগলে রেখেছেন এই প্রথাগুলি।
বর্ধমানে দামোদরপল্লীর চৌধুরী পরিবার তেমনই এক পরিবার। পরিবারের কর্তা ১৯৩৯ সালে ম্যাট্রিকে পাশ করে কলকাতা আসেন। দেশভাগের পর আসে গোটা পরিবার। বলা ভাল আসতে বাধ্য হন। সেই বর্ধিষ্ণু পরিবারের অনেকে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ছিটকে গেছেন । কিন্তু প্রবোধ চৌধুরী এইসব রিচ্যুয়াল অর্থাৎ প্রথা আগলে রেখেছিলেন। ১৯৯২ সালে তার মৃত্যুর পর সেই যাত্রা থমকে যায়।পরো তাঁর বড় ছেলে ২০০১ সালে আবার তা চালু করেন।
পরিবারের মেজো ছেলে শ্যামল চৌধুরী জানান,এই প্রথা ’শস্যভাবনার’ সাথে জড়িত। পরিবারের সবাই সন্ধ্যায় একসাথে জড়ো হন। ভক্তিভরে মাকে স্মরণ করা হয়।পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্য জয়ন্ত চৌধুরী জানান; গনেশ মূর্তির সামনে একটি রেকাবিতে ধান; মৃত্তিকা; সোনা; রূপো; মুদ্রা; পান; সুপারি; কাচি হলুদ আরো অনেক কিছু থাকে। আগে পরিবারের সংগ্রহের রৌপ্যমুদ্রাও রেকাবিতে রাখা হত । কিন্তু সেই মুদ্রা হারিয়ে যাবার পর ’রেপ্লিকায়’ কাজ সারা হয়। পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের কন্যা স্নেহাা চৌধুরী জানান; এই সব পবিত্র দ্রব্যের আলাদা আলাদা কদর আছে। বৃষ; গজ : তুরগা; দক্ষিণাবর্ত বহ্নিও পবিত্র। এইসব গুলো গালে ঠেকানো হয়। দর্শন করা হয়। ঘ্রাণ নেওয়া হয়। দর্পনে মুখ দেখা হয়। এরপর প্রণাম বা আলিঙ্গনের পালা। সবশেষে সবাই বাইরে চলে আসেন। সবাই কিছু দূর হেঁটে যান। এরপর চন্দ্রদর্শন করে ফিরে আসেন।
চৌধুরী পরিবার সদস্যদের কথা অনুযায়ী তাঁদের পরিবার একদা বাংলাদেশের হবিবপুরের অধিবাসী ছিলেন। ওই গ্রামের অপর নাম ছিল কেশবপুর। যা চৌধুরী পরিবারের উর্ধতন পুরুষ রামকেশব চৌধুরীর নামে বলে প্রচলিত ছিল। বৈকুন্ঠ চৌধুরীর পুত্র প্রিয়নাথ চৌধুরী ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। একই সাথে তিনি হোমিওপ্যাথি ডাক্তার ও ছিলেন।পরিবারের একসময় স্বচ্ছলতা থাকলেও দেশভাগের আগে মোটেই আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। ওইরকম জলা পরিবেশে বালাম চালের চাষ হলেও তা খুব অপ্রতুল ছিল। প্রিয়নাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র সংসারী হলেও ছিলেন আপনভালা। তার চার পুত্র কন্যা ; স্ত্রী এবং মাকে নিয়ে অথৈ জলে পড়েন দেশবিভাগের পর। বরিশালে দাঙ্গার পর একমাত্র চাকুরিজীবী কনিষ্ঠ পুত্র প্রবোধকুমার তাঁর মা সহ পরিবারকে নিয়ে ত্রিবেণীতে বসবাস শুরু করেন। রিলিফ অফিসার আত্মীয় হওয়া সত্বেও পরিবারের কাউকে তিনি ক্যাম্পে যেতে দেন নি। তার আয়েই লড়াই শুরু হয় নতুন করে। দীর্ঘদিন পরে সবাই নিজের পায়ে দাড়ালে প্রবোধকুমার বিবাহ করেন রাণাঘাট ক্যাম্পের সুন্দরী সদ্য তরুণী লক্ষ্মীরাণীকে।
পরিবার সদস্য পার্থ চৌধুরী বলেন ,প্রবোধকুমার তখন মাঝবয়সী। নতুন সংসার পাতার এই লড়াইটা প্রবোধকুমার একাই লড়েন স্ত্রীকে নিয়ে। কেউ পাশে ছিল না। একসময় চলে আসেন বর্ধমানে।কিন্তু শিকড়ের টান ভোলেন নি। প্রথাগুলিকে তিনি হারিয়ে যেতে দেন নি। তার স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে এই যাত্রার মত প্রথাগুলি। সেতুবন্ধন করে রেখেছে পূর্ব আর পশ্চিমবাংলার অনুপম ঐতিহ্যকে।।