প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,৩১ ডিসেম্বর : রবার্ট ক্লাইভ থেকে শুরু করে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র,সবাই মজে ছিলেন ’সিঙ্গারার’ স্বাদে।বেকারত্ত্বের জ্বালা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই চালাতে নেমে সেই ত্রিভূজাকৃতি মুখরোচক খাবার সিঙ্গারা প্রস্তুতে মন নিবেশ করেন আমলকান্তি হাটি। সেই থেকে আজ ৩০ বছর অতিক্রান্ত,পূর্ব বর্ধমানের রায়নার শ্যামসুন্দর অঞ্চলের চাতর গ্রামের অমলকান্তি সিঙ্গারাকে আঁকড়েই রয়ে আছেন।স্বাদের মাহাত্ম্যে তাঁর তৈরি সিঙ্গারার খ্যাতি এখন রায়না ছাড়িয়ে গোটা রাঢ়বঙ্গ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।তাই বিকাল হলেই অমলকান্তির ছোট খাট দোকানের সামনে পড়ে যায় মস্ত লাইন।প্রতিদিন বিকালে দোকান খুলে তিন ঘন্টার মধ্যে অমলকান্তি ৭ টাকা পিস দরের ১২০০ পিস সিঙ্গারা বিক্রী করে ফেলেন ।এমন নজির গড়ে অমলকান্তি এখন কার্যত বঙ্গের ’সিঙ্গারা সম্রাট’ বনে গিয়েছেন ।
রাজ্যের শস্যগেলা হিসাবে পরিচিত পূর্ব বর্ধমান জেলা।খাস ধান ও সুগন্ধী ধান চাষে এই জেলার রায়নার চাষিরা যথেষ্টই সুনাম কুড়িয়েছেন। এর সাথে আলু ও সবজি তো রয়েইছে।এমন এক কৃষি অধ্যুষিত এলাকার বাসিন্দা হয়েও অমলকান্তি হাটি চাষ নিয়ে কখনই সেভাবে মাথা ঘামাতে চান নি।উল্টে বেকারত্ত্বের জ্বালা থেকে নিস্কৃতি পেতে তিনি তাঁর যৌবন জীবন থেকেই তেলেভাজা ব্যবসা নিয়ে মাথা ঘামানো শুরু করেন।অমলকান্তির কথা অনুযায়ী,”প্রথম দিকে তিনি বেগুনি, আলুর চপ এসব তৈরি করে বিক্রি করা শুরু করেছিলেন । কিন্তু তাতে ব্যবসায়ীক শ্রীবৃদ্ধি তেমন না মেলায় তিনি বিকল্প মুখরোচক খাবার প্রস্তুত করা নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করেন।তিনি ঠিক করে নেন,নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় এবং রবার্ট ক্লাইভ যে সিঙ্গারা খেয়ে মোহিত হয়ে ছিলেন তার থেকেও ভাল সিঙ্গারা তিনি তৈরি করবেন।শুধু ভাবা নয়,বাস্তবেও সেটা তিনি করে দেখিয়েছেন।
প্রতিদিন সকাল হলেই অমলকান্তি হাটি তাঁর স্ত্রী ও একজন কর্মচারীকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে শুরুকরে দেন সিঙ্গারা তৈরির প্রস্তুতি।অমলকান্তি বলেন,’সিঙ্গারার স্বাদের মূল রহস্যটা যে সিঙ্গারার ’পুরেই’ লুকিয়ে থাকে সেটা আমি প্রথম থেকেই খুব ভাল ভাবে বুঝে গিয়ে ছিলাম।তাই আমি সেরার সেরা ’পুর’ তৈরিতেই সব বেশী গুরুত্ব দিয়েছি। সেই মত ১২০০ পিস সিঙ্গারা তৈরির জন্য প্রতিদিন ৬০ কেজি আলুর খোসা ছাড়িয়ে সাইজ মত কোটা হয় । কাটা আলু সেদ্ধ করে নেওয়ার পর প্রয়োজন মত পিঁয়াজ,আদা ও রসুনের খোসা ছাড়িয়ে তা বেটেও ফেলা হয়।সাথে সাথে চলে নারকেল কুচানো এবং ধনেপাতা,বিট,গাজর,টমেটো কুচানো।এইসব উপাদান ছাড়াও নামি দামি কোম্পানির বিভিন্ন মশলা,ভাল কাশ্মীরি মেথিপাতা, কড়াইশুটি, বাদাম,কাজু ও কিশমিশ পরিমাণ মত নিয়ে নেন।বিশেষ রন্ধন প্রণালী মেনে এইসব উপাদান ভালকরে কষে ’পুর’ তৈরি করে ফেলেন।আমলকান্তি জানান,বারো মাস এইসব উপাদান দিয়েই তিনি সিঙ্গারার ’পুর’ তৈরি হয়ে থাকেন।
বিকালে দোকান খুলে অমলকান্তি বাবু প্রথমেই বড় কড়াইে ডালডা ঘি ঢেলে গ্যাসের উনানে চাপিয়ে দেন। ওই সময়ে দোকানের চার-পাঁচ জন কর্মচারীর কেউ ময়দা মাখা,আবার কেউ লেচি কেটে তাতে তাঁর তৈরি সিঙ্গারার ’পুর’ ভরার কাজ শুরু করেদেন।বিকাল পাঁচটা থেকেই সিঙ্গারা কিনতে আসা খরিদ্দারের লাইন পড়ে যায় তাঁর দোকানের সামনে।গরম ডালডায় সিঙ্গারা ভেজে একের পর এক খরিদ্দারে হাতে তিনি তুলেদেন।প্রতি পিস সিঙ্গারার দাম তিনি রেখেছেন ৭ টাকা।সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে ৮ টার মধ্যে তাঁর ১২০০পিস পিস সিঙ্গারা বিক্রি হয়ে যায় বলে অমলকান্তি হাটি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি বলেন,’সিঙ্গারাই তাঁর জীবনে শ্রীবৃদ্ধি এনে দিয়েছে।
ক্রেতা অরিন্দম খাঁ ও শেখ ফজলুল হক বলেন, ‘চাতরের অমলকান্তি হাটির দোকানের সিঙ্গারার স্বাদই আলাদা।এমন স্বাদের সিঙ্গারার জুড়ি মেলা ভার।এই সিঙ্গারার স্বাদ পেতে তাই তাঁর মত দূর দূরান্তের অনেক খরিদ্দারা চাতরে ছুটে আসেন“।চাতর গ্রামের বাসিন্দারা বলেন,’প্রত্যন্ত গ্রামে দোকান খুলে বসে দৈনিক ৮ হাজারের বেশী টাকার সিঙ্গারা বিক্রী করে আমলাকন্তি প্রমাণ করে দিয়েছেন ’চপ শিল্প’ হেলাফেলার শিল্প নয়’ ।অমলকান্তির মেয়ে মুনমুন খাঁ বলেন,“স্বল্প পুঁজি নিয়ে সিঙ্গারা ব্যবসায় নেমে আমার বাবা সংসারে সম্বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। লেখাপড়া শেখিয়ে ধুমধাম করে আমাদের তিন বোনকে বিয়ে দিয়েছেন।আমার বাবার হাত যশে চাতরের সিঙ্গারা এখন স্বনামধন্য।।