এইদিন ওয়েবডেস্ক,বারাণসী,০৭ মার্চ : মুঘল হানাদার আওরঙ্গজেবের সৈন্যরা মন্দির ভেঙ্গেছে, মন্দিরের কোষাগার লুট করেছে কিন্তু ভগবান কাশী বিশ্বনাথের পবিত্র শিবলিঙ্গকে এক চুলও সরাতে পারেনি, আওরঙ্গজেবের দরবারের লেখকও একথা স্বীকার করে গেছেন । প্রাচীন কাশী বিশ্বনাথ মন্দির সম্পর্কিত প্রমাণ হিসাবে অনেক বই পাওয়া যায়, যা প্রমাণ করে যে বাবা বিশ্বনাথ জ্ঞানভাপির বিতর্কিত কাঠামোতে অবিমুক্ত আকারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন যেখানে এখন শিবলিঙ্গ পাওয়া গেছে। মন্দির ভাঙার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ ‘মা আসির-ই-আলমগিরি’ নামে একটি গ্রন্থও থেকে পাওয়া যায় । এই বইটি ১৭১০ সালে আওরঙ্গজেবের দরবারের লেখক সাকি মুস্তাইদ খান লিখেছিলেন। এক গ্রন্থেই বিশ্বনাথ মন্দির ভেঙে ফেলার জন্য আওরঙ্গজেব কর্তৃক জারি করা রাজকীয় আদেশের উল্লেখ রয়েছে।
ফার্সি ভাষায় জারি করা আদেশ নম্বর ১ : জ্ঞানবাপী সেই স্থান যেখানে শিবের উৎপত্তিস্থল কাশী বলে মনে করা হয়। যেখানে শিব স্বয়ং আভিমুক্তেশ্বর লিঙ্গের রূপে এমনভাবে উপবিষ্ট আছেন যে হানাদারদের অনেক চেষ্টা করেও তাকে সরাতে পারেনি, যদিও মুহাম্মদ ঘোরি, সুলতান মাহমুদ শাহ, শাহজাহান সহ অনেক মুঘল আক্রমণকারীরা এই শিবলিঙ্গ সরানোর চেষ্টা করেছিল । পরবর্তীতে ১৬৬৯ সালে, আওরঙ্গজেবের শাসনকালে, যখন মূল মন্দিরটি ভেঙে ফেলে মণ্ডপের উপরে একটি গম্বুজ খিলান তৈরি করা হয় এবং এটি একটি মসজিদ হিসাবে নির্মাণ করা হয়,তখনো শিবলিঙ্গটি যথাস্থানেই বিচারজমান ছিল । এখানেই ওজুখানা তৈরি করা হয়েছিল যেখানে নামাজিরা তাদের হাত-পা ধোয়।
ওই স্থান থেকে প্রায় ৪০ ফুট দূরে একই দিকে মাথা রেখে বসে থাকেন নন্দী মহারাজ । সে কারণে জ্ঞানভাপি কাঠামো প্রধান মন্দির হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
মুঘল আমলের প্রায় সকল ঐতিহাসিক শিবলিঙ্গের ক্ষতি না হওয়ার কথা উল্লেখ করে লিখেছেন যে, কাশীর প্রধান শিবলিঙ্গ ভেঙে ফেলার পর যখন শিবলিঙ্গটিকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, তখন সমস্ত চেষ্টা সত্ত্বেও শিবলিঙ্গটি ধ্বংস করতে পারেনি মুঘল হানাদাররা । তার আসল জায়গা থেকে একচুলও সরানো সম্ভব হয়নি শিবলিঙ্গটি । শেষ পর্যন্ত শিবলিঙ্গটি পরিত্যক্ত হয় এবং তারা সমস্ত ধন লুট করে চলে যায় হানাদাররা ।
শিব মহাপুরাণে শিব ও পার্বতীর আদি স্থান কাশী বিশ্বনাথকে প্রথম লিঙ্গ হিসেবে ধরা হয়েছে । মহাভারতেও এর উল্লেখ আছে। যদি আমরা আওরঙ্গজেবের আগে যাই, এই মন্দিরটি ১১ শতক পর্যন্ত তার আসল রূপে ছিল। এই মন্দির ধ্বংসের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১০৩৪ সালে। এরপর ১১৯৪ সালে মহম্মদ ঘোরি এটি লুট করে ভেঙে দেয় । তখন কাশীর লোকেরা নিজেদের মত করে এটি নির্মাণ করলেও ১৪৪৭ খ্রিস্টাব্দে জৌনপুরের সুলতান মাহমুদ শাহ এটিকে আবার ধ্বংস করে দেয় । তারপর ১৫৮৫ সালে, রাজা টোডরমলের সহায়তায় পণ্ডিত নারায়ণ ভট্ট মন্দিরটি পূণঃনির্মান করান, কিন্তু ১৬৩২ সালে, মুঘল হানাদার শাহজাহান আবারও কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ভেঙে ফেলার জন্য সেনাবাহিনীর একটি দল পাঠায় । কিন্তু হিন্দুদের প্রতিরোধের কারণে মুঘল বাহিনী তার উদ্দেশ্য সফল করতে পারেনি । তবে এই সংঘর্ষে কাশীর ৬৩ টি সুপ্রাচীন মন্দির ধ্বংস হয়ে যায়। এর পরে, আওরঙ্গজেব দ্বারা সবচেয়ে বড় ধ্বংসযজ্ঞ ঘটানো হয় যা এখনও কাশীর কপালে সবচেয়ে বড় দাগ হিসাবে বিদ্যমান ।
সাকি মুস্তেদ খানের ‘মাসির-ই-আলমগিরি’ বই অনুসারে, আওরঙ্গজেব ১৬ জিলকাদা হিজরি ১০৭৯ অর্থাৎ ১৬৬৯ সালের ১৮ 18 এপ্রিল মন্দিরটি ভেঙে ফেলার আদেশ জারি করেছিল । এছাড়া বারাণসীর ব্রাহ্মণ, পুরোহিত ও পণ্ডিতদের মুসলমান করার আদেশ জারিও করে আওরঙ্গজেব । কাশি বিশ্বনাথ মন্দিরের প্রতি আওরঙ্গজেবের ক্ষোভের একটি কারণ ছিল এটি সংস্কৃত শিক্ষার একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল এবং দারাশিকোহ এখানে সংস্কৃত অধ্যয়ন করতেন । ঔরঙ্গজেবের নির্দেশে মন্দির ভাঙার পর তার নাম রাখা হয় আঞ্জুমান আঞ্জামিয়া জামে মসজিদ।
কিন্তু পরে জ্ঞানবাপী কূপের কারণে এর নাম জ্ঞানবাপী মসজিদ থেকে যায়।
শিবলিঙ্গ ধ্বংসের চেষ্টা: মুঘল হানাদারদের দ্বারা বেশ কয়েক বার আক্রমণ করে মূল শিবলিঙ্গটি ধ্বংস করে তাদের সাথে নিয়ে যাওয়ার অনেক চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু প্রতিবারই আক্রমণকারীদের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। শিবমহাপুরাণের ২২ তম অধ্যায়ের ২১ তম শ্লোকে এর একটি উত্তর পাওয়া যায়। এটা আজকাল আলোচনার বিষয়। কাশী বিদাত পরিষদ আরও উল্লেখ করেছে যে মুঘল আক্রমণকারীরা সর্বদা কাশীর মন্দিরগুলিকে নিশানা করত । বহু শতাব্দীর আক্রমণে তারা সময়ে সময়ে ক্ষতিও করেছে । মুঘল হানাদারদের পান্ডারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ সময়ে কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে হামলা চালায়। মন্দিরের ধনভাণ্ডার লুট হয়ে গেলেও বহু চেষ্টা করেও বিশ্বেশ্বর শিবলিঙ্গটিকে সঙ্গে নিতে পারেননি। এমনকি শিবলিঙ্গও তার স্থান থেকে সরাতে পর্যন্ত পারেনি। কিন্তু কেন ওই পবিত্র শিবলিঙ্গকে তার অবস্থান থেকে একচুলও সরাতে পারেনি মুঘল থানাদাররা ? এর ব্যাখ্যা আছে শিবমহাপুরাণে । শিবমহাপুরাণের একটি শ্লোক হল :-
‘অবিমুক্তম স্বয়ং লিঙ্গ স্থানম পরমাত্মান।
ন খশ্বয় ত্যজ্যমিন্দ ক্ষেত্রম মামনস্কম্।
অনেক পণ্ডিত এই বলে ব্যাখ্যা করেছেন যে মূল শিবলিঙ্গ কাশীর বাইরে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় কারণ মহাদেব শিব এখানে অমুক্ত রূপে প্রতিষ্ঠিত । শ্লোকটির ভিত্তিতেই বলা হচ্ছে যে শিব নিজেই আদেশ দিয়েছিলেন যে আমার জ্যোতির্লিঙ্গ, যা আমার অংশ, এই অঞ্চলটি কখনই ছেড়ে যাবে না। এই বলে দেবাদিদেব মহাদেব তাঁর ত্রিশূলের সাহায্যে কাশীতে এই জ্যোতির্লিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেন ।
আমরা যদি পরবর্তী অন্যান্য প্রমাণের কথা বলি, কাশী বিশ্বনাথের ইতিহাস মুঘলদের আক্রমণের পর থেকে বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে। আজকের আইনি প্রক্রিয়াও নতুন নয়। ১৮ শতকে, মারাঠা সর্দার মন্দিরটিকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা চালান এবং ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে তিনি মন্দিরের জন্য ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য বাদশা শাহের কাছ থেকে একটি আদেশও পান। কিন্তু ততদিনে ভারত চলে গেছে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে ।
১৮০৯ সালে, কাশীর হিন্দুরা মন্দিরের জায়গায় নির্মিত মসজিদটি দখল করে, যা আজকে জ্ঞানবাপি মসজিদ নামে পরিচিত। তারপর ১৮১০ সালে, কাশীর তৎকালীন ডিএম ওয়াটসন জ্ঞানবাপি কমপ্লেক্স হিন্দুদের কাছে হস্তান্তর করার জন্য একটি চিঠি লিখেছিলেন। ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াটসন ১৮১০ সালের ৩০ ডিসেম্বর ‘কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট’-এ বলেছিলেন, ‘জ্ঞানবাপি কমপ্লেক্স চিরতরে হিন্দুদের কাছে হস্তান্তর করা উচিত। ওই কমপ্লেক্সের সর্বত্রই হিন্দু দেব-দেবীর মন্দির রয়েছে । মন্দিরের মাঝখানে একটি মসজিদের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে জায়গাটিও হিন্দুদের।’
১৯৩৬ সালে কাশী বিদ্যা পরিষদের সংগঠন মন্ত্রী, পন্ডিত গোবিন্দ শর্মা বেশ কিছু অকাট্য প্রমাণ উপস্থাপন করেছিলেন । পন্ডিত গোবিন্দ শর্মা বলেছেন যে বিশ্বনাথ মন্দির সম্পর্কিত প্রমাণ হিসাবে অনেক বই পাওয়া যায়, তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হল ‘মা আসির-ই-আলমগিরি’ নামের বইটি। এই বইটি ১৭১০ সালে হানাদার আওরঙ্গজেবের দরবারের লেখক সাকি মুস্তাইদ খান লিখেছিলেন। একই গ্রন্থে আওরঙ্গজেব যে ফরমানে বিশ্বনাথ মন্দির ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন তার উল্লেখ আছে ।
১৯৩৬ সালে আদালতে উভয় পক্ষের সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা হয়। ‘মা আসির-ই-আলমগিরি’ এবং আওরঙ্গজেবের ফরমান নিয়েও আলোচনা হয় । তারপর মুসলমানরা উর্দুতে লেখা ‘মা আছির-ই-আলমগিরি’ পেশ করে, যাতে বিশ্বনাথ মন্দির ভাঙার কথা বা আওরঙ্গজেবের এমন কোনো আদেশের উল্লেখ ছিল না। কথিত আছে যে, যখন হিন্দু পক্ষ এই প্রতারণার দ্বারা হতাশ হতে শুরু করে তার কিছু দিনের মধ্যে কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ ডঃ পরমাত্মা শরণ ১৮৭১ সালে বেঙ্গল এশিয়াটিক সোসাইটি দ্বারা ফারসি ভাষায় লেখা মূল গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ‘মা আসির-ই-আলমগিরি’ আদালতে পেশ করা হয়।
‘মা আসির-ই-আলমগিরি’তে ফার্সি ভাষায় রাজকীয় ডিক্রি নম্বর ২ :-
‘মা আসির-ই-আলমগিরি’র ৮৮ নম্বর পৃষ্ঠায় আওরঙ্গজেবের নির্দেশে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ভেঙে ফেলার উল্লেখ আছে। কথিত আছে যে, তখনই হায়দ্রাবাদের ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ষড়যন্ত্রটি ফাঁস হয়ে যায়। একই বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩২ সালে ‘মা আসির-ই-আলমগিরি’-এর উর্দু অনুবাদ প্রকাশ করেছিল। যেখান থেকে শ্রী কাশী বিশ্বনাথের ইতিহাস সম্বলিত পাতাগুলো পরিকল্পিতভাবে মুছে দেয় ।
আজও ভারতের তথাকথিত সেকুলার এবং বামপন্থীদের সহায়তায় মুসলিম পক্ষ বিতর্কিত জ্ঞানবাপী মসকিদ নিয়ে একই ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে । ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক অগণিত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আজও হিন্দুদের পবিত্রতম স্থান শিবধাম বারাণসীর বিশ্বেশ্বর শিবলিঙ্গের পূজা অর্চনা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন হিন্দুরা । সম্প্রতি এ এস আই এর রিপোর্টেও সাফ বলা হয়েছে যে বৃহৎ হিন্দু মন্দির ভেঙে জ্ঞানবাপীর বিতর্কিত কাঠামো নির্মিত হয়েছিল । যদিও বারাণসী জেলা আদালতের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে গেছে মুসলিম পক্ষ । এখন দেখার যে সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান কি হয় ।।