অদিতি গাইন,১৮ জুলাই : বিষধর বা নির্বিষ – যাইহোক না কেন সাপ এর নাম শুনলেই আমরা যেমন আঁতকে উঠি তেমনি দেখলেই তাকে মেরে ফেলতে উদ্যত হই। এতে যে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে সেটা আমরা তখন মাথায় রাখিনা। একটাই নীতি –’শত্রুর শেষ রাখতে নাই, বিনাশ করতে হয় ।’
হঠাৎ মাঝরাতে ফোনটা বেজে উঠল। চমকে উঠে ফোনটা রিসিভ করতেই ভেসে এল আতঙ্কিত কণ্ঠ –হ্যালো অদিতি, আমার ঘরে একটা গোসাপ ঢুকে পড়েছে। তুমি একটু আসবে ?
উত্তর দিলাম — না ! গোসাপ তো সাপ নয়, বড় টিকটিকি জাতীয় প্রাণী। তাই ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই আপনি দরজা, জানালা খোলা রাখুন ও নিজেই চলে যাবে !
— ২ ঘন্টা ধরে চেষ্টা করছি, বেরই হচ্ছে না। আলমারির তলায় ঢুকে ছিল, এখন আলনার তলায় ঢুকে গেছে। বাড়িতে খাওয়া দাওয়া সব বন্ধ। ভয়ে ঘরে ঢুকতে পারছি না। তুমি যদি একটু আসো তাহলে খুবই উপকার হয়।
বাংলায় গোসাপ, স্বর্ণ গোধিকা, সোনাগো, সোনাগুই, গোহরকেল, গরগেল – বিভিন্ন নামে ডাকা হয় ! ইংরেজিতে Golden Monitor Lizard বা Yellow Monitor Lizard বলা হয়। এদের বৈজ্ঞানিক নাম Varanus flavescens.
গোসাপ বললেও এরা সাপ নয়। এদের বড় ধরণের টিকটিকি বলা যায়! এদের জিভ সাপের মতো চেরা। এরা মাঠ-ঘাট, জলাজমি ও জলাশয়ের আশেপাশের গর্তে বসবাস করে। এরা সাধারণত লম্বায় প্রায় ২.৫-৩ ফুট পর্যন্ত হয়। প্রাপ্ত বয়স্কদের ওজন প্রায় ১.৫ কেজির মত হয়। পুরুষরা স্ত্রী গোসাপের তুলনায় বড়ো হয়।
এরা সাধারণত হলদে-বাদামী বর্ণের হয়। গায়ে আড়াআড়ি লাল ও হলদে ডোরাকাটা দাগ থাকে। পিঠের দিকে খেয়াল করলে বাদামী রঙের ছোট ছোট ফুলের মতো ছোপ দেখা যায়। তবে বাচ্চাদের গায়ে উজ্জ্বল হলুদ দাগ ও লালচে বাদামি ছোপ থাকে।
গোসাপেদের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার কমোডো-ড্রাগন সবচেয়ে বড়ো হয়। তাদের মুখের লালায় সাংঘাতিক কিছু ব্যাকটেরিয়া থাকে যা মানুষ সহ অন্যান্য স্তন্যপায়ীদের মেরে ফেলতে পারে।
তবে বাংলায় তিন প্রজাতির গোসাপ পাওয়া যায়- ১) কৃষ্ণগোধিকা (Bengal Monitor Lizard )- কালচে ধূসর রঙের উপর কালো ফুটকি বা ছিট ছিট থাকে। মাথা ভোঁতা ও ঘাড় ছোট হয়। লম্বায় প্রায় ৫ থেকে ৬ ফুট পর্যন্ত হয়।
২) রামগোধিকা ( Water Monitor Lizard) – এরা আকারে খুব বড়ো হয়। কালচে ধূসর রঙের শরীরের উপর হলুদ বা হলদে-সাদা গোল গোল ছোপ বা রিং থাকে, মাথা ও ঘাড় লম্বাটে হয়। এরা লম্বায় প্রায় ৭-১০ ফুট পর্যন্ত হয়।
৩) স্বর্ণগোধিকা (Yellow Monitor Lizard) – এরা একটু ছোট হয়। এদের গায়ের রং উজ্জ্বল হলুদ বা হলদেটে বাদামী রঙের হয়। তার উপর হলুদ দাগ থাকে। পিঠে ছোট ছোট বাদামি রঙের ফুলের মত ছোপ থাকে। মাথা ছোট ও ভোঁতা হয়।
এই তিন প্রজাতির গোসাপই সম্পূর্ণ নির্বিষ। এরা খুবই উপকারী প্রাণী। আমাদের অজান্তে এরা সাপের বাচ্চা ও সাপের ডিম, ইঁদুর, ব্যাঙ ও পচা-গলা উচ্ছিষ্ট খেয়ে পরিবেশ পরিষ্কার রাখে ও রোগ জীবাণুর বাহকদের খেয়ে আমাদের রোগ মুক্ত করে।
কৃষ্ণগোধিকা বা সাধারণ গোসাপের দেখা মিললেও এই স্বর্ণগোধিকা খুবই বিপন্ন। এরা সংরক্ষিত প্রজাতি। তাই এদের মারা, ধরা বা পোষা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যদিও এদের খুব একটা দেখা যায় না। যদি আপনি কখনো এদের দেখতে পান তাহলে অবশ্যই ক্যামেরা তুলুন, লাঠি নয় !
সাধারণ মানুষের ভয়ের জন্য এরা যেমন মারা পরে তেমনি কিছু উপজাতি এদের মাংসের জন্য শিকার করে। ওরা মনে করে এদের মাংস খেলে পুরুষের যৌনশক্তি বৃদ্ধি পায়। এটা কুসংস্কার। এই কুসংস্কারের ফলে নির্বিচারে এরা মারা পরে। এরা আত্মরক্ষার জন্য লেজ দিয়ে চাবুকের মতো আঘাত করে। তবে সেই আঘাতে কোনো ক্ষতি হয় না বা পা পচে যায় না।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ বা International Union for Conservation of Nature and Natural Resources (IUCN) তালিকায় এদের মহাবিপন্ন প্রজাতি বলা হয়েছে। ভারতে বন্যপ্রাণ আইন বা ইন্ডিয়ান ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশন এ্যাক্ট দ্বারা এরা সংরক্ষিত প্রজাতি।
বাড়ির আশেপাশে যতবেশি গোসাপ, ভাম বেড়াল, বন বেড়াল, বেজি থাকবে ততবেশি বিষধর সাপেদের থেকে আমরা নিরাপদে থাকব। তাই এদের দেখতে পেলে না মেরে প্রয়োজনে বন বিভাগে যোগাযোগ করা উচিত।
যাইহোক, গোসাপটি উদ্ধারের পর আমি ওই বাড়ির সদস্য এবং আশপাশের মানুষদের এই গোসাপ সম্পর্কে সচেতন করি। আমি বোঝাই যে এরা কতো উপকারী প্রাণী। বোঝানোর শেষে এই সুন্দর প্রকৃতির সন্তানটিকে প্রকৃতির কোলে মুক্ত করি।
ভালো থাকুক প্রকৃতির সন্তানেরা । শিখুন, সতর্ক থাকুন এবং এইসব অবলা প্রাণীদের রক্ষা করুন। এই পৃথিবী প্রাণের জন্য সৃষ্টি হয়েছে। তবে শুধুমাত্র মানুষের প্রাণের জন্য নয় ।।