এইদিন ওয়েবডেস্ক,মালদা,২২ ফেব্রুয়ারী : মুঘল হানাদারদের দ্বারা ধ্বংস করা প্রাচীন হিন্দু মন্দিরগুলির তালিকার অগ্রভাগে আছে অযোদ্ধার বাবরি মসজিদ, বারাণসীর জ্ঞানভাপি মসজিদ ও মথুরার শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমিতে নির্মিত শাহী ঈদগাহ মসজিদ । তার মধ্যে অযোদ্ধায় নতুন রামমন্দিরে রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন হয়ে গেছে । জ্ঞানভাপি মসজিদের এএসআই- এর সমীক্ষা হিন্দুপক্ষের পক্ষেও গেছে । মথুরার শাহী ঈদগাহের এএসআই সমীক্ষার পক্ষে রায় দিয়েছে আদালত । এখন হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে আওয়াজ উঠছে,”অযোধ্যা তো ব্যস ঝাঁকি হ্যায়, কাশী মথুরা আভি বাকি হ্যায়।” কিন্তু পশ্চিমবঙ্গেও এমনই একটি বিতর্কিত ধর্মীয় স্থান রয়েছে, যাকে ঘিরেও তোলপাড় শুরু হয়েছে দেশে । আর ওই বিতর্কিত স্থানটি হল মালদার আদিনা মসজিদ ।
দাবি করা হয় যে ইসলামিক হানাদার সুলতান সিকান্দার শাহ ১৩৬৯ সালে হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দিরগুলি ভেঙে দিয়ে মসজিদ তৈরি করেছিলেন। এর আগে ২০২২ সালের মে মাসে বিজেপি নেতা রতিন্দ্র বসু এই দাবি করে বলেছিলেন যে এই বিতর্কিত মসজিদের নীচে ‘আদিনাথ মন্দির’ রয়েছে। তিনি একটি টুইটে বলেছিলেন যে জিতু সরদার এর জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন ৷ তিনি বলেছিলেন,’মুসলিম ও ব্রিটিশ শাসকদের হাত থেকে এই মন্দির বাঁচাতে গিয়ে জিতু সর্দার মারা যান। স্থানীয় বিধায়ক চিন্ময় দেব বর্মনের সঙ্গে এখানে বেড়াতে গিয়ে এই বিষয়টি আমার মনে অনেকবার এসেছিল। কাশীর ভগবান বিশ্বনাথ নিজের জায়গায় ফিরে এসেছেন, ভগবান আদিনাথের কি এখন সুযোগ আছে?’
সম্প্রতি এই বিতর্ক আরও উসকে দিয়েছেন বৃন্দাবনের বিশ্ববিদ্যা ট্রাস্টেরও প্রধান নবীন সন্ন্যাসী হিরন্ময় গোস্বামী। তিনি শনিবার (১৭ ফেব্রুয়ারী,২০২৪) আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (এএসআই) দ্বারা সুরক্ষিত বিতর্কিত আদিনা মসজিদে এসে পূজো করেন । কিছু অনুসারীসহ তিনি এখানে পূজা ও মন্ত্র উচ্চারণও করতে থাকেন। কিন্তু এলাকার মুসলমানরা গাজল থানায় খবর দেয় । খবর পেয়ে সেখানে আসেন স্থানীয় থানার সাব ইন্সপেক্টর নবীন চন্দ্র পোদ্দার । তিনি হিরন্ময় গোস্বামীকে মন্দিরে দেবমূর্তি প্রণাম করতে নিষেধ করলে দু’জনের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদ শুরু হয় । এই ঘটনায় হিরন্ময় গোস্বামীর বিরুদ্ধে মালদহের গাজোল থানায় এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। এক পুলিশ অফিসার এই প্রসঙ্গে সংবাদপত্র টেলিগ্রাফকে বলেন,’আমরা এএসআইয়ের অভিযোগের ভিত্তিতে একটি এফআইআর নথিভুক্ত করেছি ।’ এই এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের কোথায় এই বিতর্কিত স্থান ? কেন এই ধর্মীয় স্থানটিকে ঘিরে বারবার বিতর্ক হয় ?
মালদা জেলার গাজোল ব্লকের ৩৯ মৌজায় রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সব থেকে বড় মসজিদ,আদিনা মসজিদ । বলা হয় এই মসজিদ শুধু পশ্চিমবঙ্গেরই নয়, সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদ। দিল্লি জামে মসজিদের এর পরই এই মসজিদের স্থান । কিন্তু এই মসজিদের প্রায় প্রতিটি পাথরেতে খোদাই করা আছে দেবদেবীর মূর্তি এবং হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন প্রতীক । যা ঘিরেই বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে ।
মালদার আদিনা মসজিদ সম্পর্কে জানতে পারা যায় বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে বাংলা সরকারের এক কর্মচারী আহেদ আলী খানের রচিত “গৌড় পান্ডুয়ার স্মৃতি” নামক একটি গ্রন্থ থেকে । এই ব্যক্তি গৌড় পান্ডুয়ার প্রাচীন পুরাকীর্তি গুলোর বিশেষ মেরামতির দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার সুবাদে দীর্ঘদিন মালদহে অবস্থান করেন । তার রচিত ওই গ্রন্থ অনুযায়ী,আদিনার মসজিদ নির্মাণ কার্য ১৩৬৪ সাল থেকে আরম্ভ করে ১৩৭৪ সালে সম্পূর্ণ করা হয়। মসজিদের দক্ষিণ পাশে জনসাধারণের নামাজ পড়ার একটি নির্দিষ্ট স্থান ছিল। এখানে আঠারোটি মিম্বার রয়েছে এবং এগুলি প্রতিটি উপরের দিকে পাথরের কাজ করা । কেন্দ্রীয় হলঘরের মাটি থেকে ৮ ফুট উপরে আসন রয়েছে যার নাম “বাদশাহো কি তখত” । এর পাশে ও বহির্গমনের পথ ছিল পশ্চিমদিকে। এখানকার মেহরাব অংশ চতুর্দিকে কোরানের বাণী লেখা । এখানে তিনটি মেহরাব এবং দুটি দরজা রয়েছে। যেগুলোতে কিছু লেখা এবং ফুল আঁকা রয়েছে, যা ঘিরেই বিস্ময়ের সৃষ্টি করে।
কিন্তু কেন দাবি করা হচ্ছে যে মন্দির ধ্বংস করে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল ? কারন হিসাবে বলা হচ্ছে যে আদিনা মসজিদের পশ্চিমে দরজা দিয়ে উঠার সময় দরজার ওপরে একটি বুদ্ধমূর্তি দেখতে পাওয়া যায় যেটি সম্পূর্ণভাবে চেঁচে তুলে ফেলা হয় । দরজা পেরিয়ে দেখা যায় সিকান্দার শাহ এর কবর । ঘরের যে অংশ সিকান্দার শাহের কবর নামে পরিচিত সেখানে একটি বড় গম্বুজ ছিল যা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। এই স্থান পেরিয়ে যেতে হয় “বাদশাহো কি তখতে” । প্রবেশ দারের চৌকাঠে বহু নৃত্যরত মুর্তি দেখা যায় । যেগুলোকে চেঁছে তোলা হয়েছে তা সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারা যায় । দরজার চৌকাঠ গুলো বিভিন্ন নকশার সজ্জিত সে যুগের হিন্দু ভাস্কর্যে পরিচয় বহন করে। এছাড়া মসজিদের মিম্বারের নিম্ন তলে অসংখ্য নকশা এবং পদ্ম ফুল খোদাই করা আছে । এই মিম্বারের সংলগ্ন রয়েছে কেন্দ্রীয় মেহরাবটি। এর আকার বিরাট। সবার উপরে জানলা দেখতে পাওয়া যায়। জানলা দিয়ে একটি দেখা যায় একটি শিবলিঙ্গ পাতলা করে বসানো রয়েছে আর রয়েছে একটি বড় পদ্ম, তার নিচে কোরানের কিছু বাণী , তার নিচে বিভিন্ন প্রকারের অলংকরণ। দুপাশে বড় বড় পদ্মফুল।
এই চিত্রকলা যেমন বিস্ময়কর, তেমনি আরো বিস্ময়কর বিষয় হলো শিবলিঙ্গ পদ্মফুল এবং কোরানের সহাবস্থান। যদিও এটি নামে মসজিদ তবুও এর স্তম্ভে নকশাগুলি সাধারণ মসজিদের থেকে বহু অমিল রয়েছে। এটা বোঝা যায় যে এই মসজিদ তৈরির কোন রকম কোন ইঞ্জিনিয়ারিং পরিকল্পনা ছিল না বলে দাবি করা হয়েছে একটি প্রতিবেদনে । হিন্দু বৌদ্ধ এবং জৈন মন্দিরের পাথরগুলি এখানে ব্যবহার করা হয়েছে । অথবা কোনো প্রাচীন মন্দিরকে ধ্বংস করেও এই আদিনা মসজিদ নির্মান করা হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে ।
কয়েক বছর আগে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে আদিনা মসজিদের গঠনগত কাঠামোর মধ্যে বিতর্কিত অবস্থান হলো “বাদশাহ কি তখত”,এর মানে রাজসিংহাসন। কিন্তু এখানে কোন সিংহাসন নেই বরং মাটি থেকে ৮ ফুট উঁচু মঞ্চের মত বা বারান্দার মত একটি অনেক বড় স্থান আছে । আবেদ আলী রচিত গ্রন্থে এর কোন সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি । আরো একটি বিতর্কিত বিষয় হল বাদশাহ কিতাবকে এর পশ্চিম পাশের দেওয়ালে কালো পাথরের মেহরাব আছে এবং তা সম্পূর্ণ কারুকার্যমন্ডিত । এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল “স্বস্তিক চিহ্ন” । এর পাশে ইসলামিক শিলালেখ দেখতে পাওয়া যায় তার সূক্ষ্মতা অনেক নিম্নমানের ও নবীনতর।
প্রতিবেদন অনুযায়ী,নামাজ ঘর বা মসজিদের মূল মূল কক্ষের পশ্চিম দিকে দুটো বৃহৎ আকারের সদ্য প্রস্ফুটিত পদ্ম দেখতে পাওয়া যায় , ঠিক যেমনটি আমরা হিন্দু মন্দিরগুলোতে অথবা বৌদ্ধমঠ ওগুলোতে দেখতে পাওয়া যায় । কারণ হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মে পদ্মফুল অতীব পবিত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। শুধু তাই নয় পুরো মসজিদ ভর্তি বিভিন্ন স্থানে ছোট বড় নানা আকারের পদ্মফুল দেখতে পাওয়া যায় । অনেকেরই দাবি যে আদিনা মসজিদ এমন বহু চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায় যার সঙ্গে ১৪০০ বছর আগে সৃষ্ট ইসলাম ধর্ম স্থাপত্য এগুলোর সঙ্গে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না ।
বিষয়টি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে লেখা হয়েছে, আবিদ আলী তার লেখাতে কোন রকম ভাবেই আদিনা মসজিদে খোদাই করা পদ্মফুল, নকশা ,স্বস্তিক চিহ্ন প্রভৃতি প্রতীকলোর অবস্থান এর সঠিক ব্যাখ্যা করতে পারেননি । উপরন্তু কোন কোন জায়গাতে তিনি এই বলে বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন যে এই সমস্ত নকশা,পদ্মফুল,বিভিন্ন হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন মঠ ও মন্দির থেকে নিয়ে এসে মসজিদটির শোভাবর্ধন করা হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন থেকেই যায় যে পৌত্তলিকতায় বিশ্বাস না করা একটি ধর্ম কিভাবে ‘কাফের’দের সৃষ্ট বিভিন্ন প্রতীক নকশা দেবদেবীর মূর্তি নিয়ে এসে মসজিদটিকে সুসজ্জিত করে তোলে এটি কি তাদের কোরান সম্মত ?
২০২০ সালের ৮ জুন সাংবাদিক প্রদীপ ভান্ডারী মালদার আদিনা মসজিদে হিন্দু ধর্মের বেশ কিছু নিদর্শনের ছবি পোস্ট করে লিখেছিলেন,’এই ছবিগুলো মনোযোগ সহকারে দেখুন, অবস্থানটি কী বলে মনে করেন? আমি আপনাকে বলি এটি আদিনা মসজিদ, মালদহ, পশ্চিমবঙ্গে। একটি ভাঙা শিবলিঙ্গ, পাথরে খোদাই করা হিন্দু দেবদেবী এবং অনেক হিন্দু নকশা। যদি হিন্দুরা এটা নিয়ে কথাও বলে তাহলে তাদের অসহিষ্ণু বলা হবে ।’
রাজ্য বিজেপির সহ সভাপতি রথীন্দ্র বোস ২০২২ সালের ৩০ মে টুইট করেছিলেন,’আদিনা মসজিদের তলায় কি ঘুমিয়ে রয়েছে সনাতনী ইতিহাস ? মালদহ জেলার গাজোল থানার ৩৯ নং মৌজায় অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় মসজিদ আদিনা মসজিদ। কিন্তু এটি সর্বৈব সত্য নয় ।’।