শ্যামসুন্দর ঘোষ,কালনা,০৯ জানুয়ারী : নদীয়া জেলা তাঁত শিল্পের জন্য বিখ্যাত ৷ সরকারিভাবে তেমন কোনো উদ্যোগ না থাকলেও ব্যক্তিগত স্তরে আজও এই শিল্পটাকে টিকিয়ে রেখে দিয়েছেন স্থানীয় মানুষজন । নদীয়া জেলার পার্শ্ববর্তী পূর্ব বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলী এলাকাতেও বহু মানুষ পরিবার আজও তাঁত বুনে জীবিকা নির্বাহ করে । তাদের কথা মাথায় রেখে আজ থেকে প্রায় ৪৩ বছর আগে,১৯৮২ সালে পূর্বস্থলী পঞ্চায়েত সমিতির উদ্যোগে তাঁত সমবায় গড়ে তোলা হয়েছিল । বিশাল বড় ভবন নির্মাণ হয়, আনা হয় অনেক তাঁত যন্ত্র । তাঁতের পোশাক তৈরির জন্য পরিকাঠামোকে ঢেলে সাজানো হয় । অল্পদিনের নামও করে প্রায় করে ফেলে পূর্বস্থলীর তাঁত সমবায় । স্থানীয় বহু পরিবার তাকে উপকৃত হয়। কিন্তু মাত্র এক দশক এই প্রতিষ্ঠানটি চলার পরই কোন এক অজানা কারণে বন্ধ হয়ে যায় । ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের পরেও পূর্বস্থলীর ওই তাঁত সমবায়ের ভাগ্য পরিবর্তনের হয়নি । পরিবর্তে ব্যাপক দুর্নীতি করে প্রতিষ্ঠানটির সর্বনাশ করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ । রাজ্যের বর্তমান শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধেই উঠছে তাঁত সমবায়ের কোটি কোটি টাকা তথরুপের অভিযোগ । অথচ এই এলাকারই বাসিন্দা হলেন স্বপন দেবনাথ । যিনি এক সময় রাজ্যের ক্ষুদ্র কুটির শিল্পমন্ত্রীও ছিলেন । কিন্তু কেন তিনিও এই তাঁত সমবায় শিল্পটাকে পুনরুদ্ধারের কোন চেষ্টা করলেন না তা প্রশ্ন তুলেছে বিজেপি ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বামফ্রন্টের জমানায় স্থানীয় কৃষক ফটিক দাস, কানু দাসদের কাছ থেকে প্রায় ৫ বিঘা জমিতে এই গড়ে তোলা হয়েছিল তাঁত সমবায় । তৈরি করা হয় অফিসের দ্বিতল ভবন,ওয়ার্কশপ, কর্মীদের জন্য শৌচাগার, গোডাউন প্রভৃতি । স্থানীয় মহিলা মায়ারানি ক্ষেত্রপাল বলেন, এখানে ৬৫ টা তাঁত ছিল । তাতে ৬৫ জন তন্তুবায় কাজ করতো । এর বাইরেও কাপড় ভাঁজ করা, রং করার জন্য আরও অনেক কর্মী ছিল । প্রচুর লোকজনের যাতায়ত ছিল । তারপরে আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল। বিগত ৩৩ বছর ধরে বন্ধ আছে । তাঁত মেশিন এখনো একটা পড়ে আছে । আর বাকি তাঁতগুলো তন্তুবায়রা নিয়ে চলে গেছে ।’
পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের আকালের মাঝে পূর্বস্থলীর তাঁত সমবায়ের দুর্নীতি নিয়ে সরগরম হয়ে উঠেছে এলাকা ৷ অভিযোগ,তাঁত সমবায়ের নামে, কোটি কোটি টাকা তছরূপ করা হয়েছে । সমবায়ের যাবতীয় নথি-পত্র গায়েব করে দিয়েছেন কর্মকর্তারা। তাঁতের যন্ত্রপাতিসহ কারখানার পরিকাঠামো পর্যন্ত বিক্রি করে দেবার অভিযোগ উঠেছে । অথচ দীর্ঘ তিন দশক কেটে যাবার পরেও ওই সব কর্ম কর্তাদের বিরুদ্ধে কোন রকম আইনত ব্যবস্থা নেয়নি রাজ্যের বর্তমান শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস । তদন্তের জন্য আজ পর্যন্ত দায়ের হয়নি কোনো এফআইআর । স্থানীয় বাসিন্দা এক ব্যক্তির অভিযোগ,’যাদের নামে জমি নেওয়া হয়েছিল ফটিক দাস ও কানু দাসদের কাছ থেকে, তারাও তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জমিটাকে তছরুপ করেছে ।’
স্থানীয় সূত্রে খবর,সমবায়ের ওই সব কর্মকর্তারা তাদের পিঠ বাঁচাতে এখন শাসক দলে ভিড়েছে । পূর্বস্থলী তথা কালনা-কাটোয়া মহকুমায় এই ধরনের বন্ধ তাঁত সমবায়ের সংখ্যা প্রায় ডজন খানেক। সম্প্রতি তাঁত সমবায়ের নামে এই কোটি কোটি টাকা তছরূপের বিষয়টি প্রকাশ্য আসতেই এলাকায় চাপা গুঞ্জন শুরু হয়েছে। বামফ্রন্টের আমলে তৈরী হওয়া এই সমস্ত তাঁত সমবায় গুলো বর্তমানে ভগ্ন দশায় পড়ে আছে। কারখানাগুলোর জন্য কোথাও কোথাও এক থেকে দশ বিঘা পর্যন্ত জমি কেনা হয়েছিলো। সুলন্টু জাহান্নগর তাঁত সমবায়ের গোটা কারখানাটাই বর্তমানে উধাও করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। পূর্বস্থলী-নবপল্লী তাঁত সমবায়টি বর্তমানে আগাছার জঙ্গলে গ্রাস করেছে। যাবতীয় তাঁত যন্ত্রপাতি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। রাত হলেই সেখানে দুস্কৃতীদের আড্ডা বসে। পলাশপুলি-পূর্বস্থলী তাঁত সমবায়ের কারখানাটিও বর্তমানে বেহাল অবস্থায় আছে । তাঁত বোনার যন্ত্রপাতিগুলো উধাও হয়ে গেছে । একই অবস্থা শ্রীরামপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের হেমায়েতপুর মোড় এবং গঙ্গানন্দপুর এর তাঁত সমবায়েও । তাঁত শিল্পের নামে রাজ্য সরকারের কোটি কোটি টাকা তচরূপ হয়েছে বলে অভিযোগ ।
এদিকে তাঁত সমবায়, কারখানার নামে কেনা বিঘের পর বিঘা এই জমির ভবিষৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে এখন । বন্ধ সমবায় গুলোর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এখনো কোন আইনানুগ ব্যাবস্থা নেওয়া হয়নি এনিয়েও প্রশ্ন তুলছেন তারস । অভিযোগ যে টাকা পয়সা নিয়ে রফা হয়ে গিয়েছে শাসক দলের সঙ্গে। যেকারণে সব জেনেও চোখ বন্ধ করে রেখেছে প্রশাসনের কর্তারা । বিজেপি নেতা স্থানীয় বাসিন্দা রাজীব ভৌমিক বলেন, ‘কালনা মহকুমার পূর্বস্থলী এলাকায় তাঁতের বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল এখানে । বামফ্রন্ট আমলে প্রচুর দুর্নীতি হয়েছে । কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে । সরকার বদল হয়েছে । কিন্তু এই তাঁত শিল্পের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি । যন্ত্রপাতি বিক্রি হয়ে গেছে । যারা এই অসৎ কাজের সঙ্গে যুক্ত তারাই দলবদল করে বর্তমান শাসক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে । খোঁজ করলে দেখা যাবে যে কোন এক মন্ত্রের নিকট আত্মীয় এই দুর্নীতির সাথে যুক্ত । অথচ রাজ্যের ক্ষুদ্র কুটির শিল্পমন্ত্রী এই এলাকার বাসিন্দা ছিলেন । কিন্তু কেন এ নিয়ে কোনো সদর্থক ভূমিকা নেওয়া হয়নি ? এখনো পর্যন্ত কারোর বিরুদ্ধে কোন এফআইআর হয়নি । তাঁত শিল্প এখানে প্রায় বন্ধের মুখে ।’ তিনি মনে করছেন যে যদি সরকারিভাবে এই শিল্প টাকে পুনরুদ্ধারের কোন ব্যবস্থা না করা হয় তাহলে হাজার হাজার তন্তুবায়কে অনাহারে মরতে হবে ।।