বইমেলার ভিড় জমেছে। বাতাসে বইয়ের পাতার গন্ধ, আলো-ঝলমলে স্টল, উচ্ছ্বাসে ভরে থাকা মানুষের কোলাহল। সেই ভিড়ের মাঝেই হাজির সৌম্য আর সঞ্চারী—আজ সৌম্যের লেখা নতুন বইয়ের প্রকাশ। নতুন প্রকাশিত বই হাতে নিয়ে সঞ্চারীর চোখে ভরে ওঠে এক অনির্বচনীয় গর্বের দীপ্তি, যেন বহু বছরের প্রতীক্ষার ফল।
সন্ধ্যার আলো ধীরে ধীরে বইমেলার মাঠকে ঘিরে ধরে। আলোকসজ্জায় ঝলমল করছে চারপাশ, অথচ কোলাহলের মাঝেও বাতাসে এক অদ্ভুত শান্তি ভেসে আছে। সেই ভিড়েই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সৌম্য আর সঞ্চারী, পাশে তাদের ছোট্ট ছেলে বাবাই। তিনজনের চোখেই এক অনাবিল পরিতৃপ্তি—যেন বহু দিনের অভিমান, দ্বিধা আর টানাপোড়েন মিলেমিশে গলে গেছে এক নিঃশ্বাসে।
মঞ্চে অন্বেষা। আলোয় ভেসে উঠেছে তার মুখ, কণ্ঠে দারুণ শক্তি, চোখে ভরপুর আত্মবিশ্বাস। আজ তার নতুন নাটকের মঞ্চায়ন। দর্শকের তুমুল হাততালি তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সাফল্যের ঝলক মুখে, তবুও তার সেই সহজ, কোমল হাসি সৌম্য-সঞ্চারীর দিকে তাকিয়ে আরও দীপ্ত হয়ে ওঠে।
সৌম্য এক ঝলক তাকায় সঞ্চারীর দিকে। তার চোখে অদ্ভুত এক আলো। মৃদু স্বরে বলে ওঠে—
“সঞ্চারী, আমি তোমাকেই ভালোবেসেছি, সবসময়। হয়তো কথায় প্রকাশ করতে পারিনি, কিন্তু আজ তোমার হাত ধরে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি—আমাদের সংসারই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সার্থকতা।”
সঞ্চারীর চোখ ভিজে ওঠে আনন্দে। বুকের ভেতর জমে থাকা সব আশঙ্কা, সন্দেহ, দুঃখ গলে গিয়ে জায়গা নেয় কেবল ভালোবাসার উচ্ছ্বাস। তার কণ্ঠ কেঁপে ওঠে, কিন্তু ঠোঁটে ফুটে ওঠে প্রশান্ত হাসি—
“আমি জানতাম, তুমি আমার ছিলে ,আর শেষমেশ তুমি আমারই।”
কিছুক্ষণ পর অন্বেষা এগিয়ে আসে। মুখে ক্লান্ত অথচ দীপ্ত হাসি। সে বাবাইকে কোলে তুলে নেয়, তার চুলে আলতো হাত বুলিয়ে দেয়। বাবাই মায়াভরা চোখে জিজ্ঞেস করে—
“অন্বেষা পিপি, তুমি আবার কবে নাটক লিখবে? আমি তোমার সব নাটক দেখতে চাই। তোমার নাটক দেখতে আমার খুব ভালো লাগে।”
সেই সরল প্রশ্নে চারপাশে যেন এক অনাবিল উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়লো। অন্বেষা শিশুর মতো হেসে বাবাইয়ের কপালে চুমু খেয়ে বলে—
“যতদিন আমি লিখব, ততদিন তুমিই হবে আমার প্রথম দর্শক।”
তারপর সৌম্য-সঞ্চারীর দিকে তাকিয়ে অন্বেষা মৃদু হেসে বলে—
“দেখো, বন্ধুত্বও এক রকম ভালোবাসা। সে জায়গা যেন কখনও হারিয়ে না যায়। তোমরা সুখে থেকো, আমি আছি সবসময়—বন্ধু হয়ে, অনুপ্রেরণা হয়ে।”
মুহূর্তটা যেন থমকে যায়। দূরে বইমেলার আলো, কাছে ভেসে আসা গানের সুর, আর তিনজন মানুষ আর এক ছোট্ট শিশুর হৃদয়ে জন্ম নেয় এক অবিনশ্বর সম্পর্ক।
সৌম্য আলতো করে সঞ্চারীর কাঁধে হাত রাখে। সঞ্চারী ঝুঁকে আসে তার বুকে। বাবাই অন্বেষার কোলে মাথা দিয়ে খুশিতে হাততালি দেয়। অন্বেষা তখন দূরে তাকিয়ে থাকে—তার চোখে আবারও নতুন স্বপ্নের আভা—নতুন নাটক, নতুন লেখা, নতুন দিগন্ত।
আকাশের মেঘ জানো আস্তে আস্তে পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। রাতের আকাশে হাজার তারা আজ মুক্তির আনন্দের মিটি মিটি হাসছে।
আর তখনই অন্বেষা মনে মনে সৌম্যের লেখা একটা কবিতার লাইন আনমনে বলে উঠলো–
“জীবনের মেলায় কেউ বন্ধু, কেউ সাথি, কেউ ভালোবাসা
তবুও আলোর পথ একটাই, যেখানে তারা সবাই একে অপরের আলো হয়ে থাকে।”

