অন্বেষার জীবনে যেন এক নতুন সূর্যোদয় হয়েছিল, কিন্তু সেই আলো ছিল একা পথ হাঁটার আলো—অপেক্ষার, নীরবতার, ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়ার আলো। সেই সময়েই সৌম্যের বিদেশযাত্রার খবরটা এলো।
—“জার্মানি যাচ্ছি পোস্ট-ডক্টরেট করার জন্য তিন বছর, হয়তো আগেই ফিরতে পারব,” বলেছিল সৌম্য এক বিকেলে, খুব স্বাভাবিক গলায়।
অন্বেষা কিছুই বলেনি। ভেতরে ভেতরে চিৎকার করে বলতে চেয়েছিল—
“আমার এখন তোমাকে খুব দরকার, আমাকে ছেড়ে যাও না, প্লিজ!”
কিন্তু ঠোঁটের কোণে আটকে থাকা সেই কথাগুলো গিলে নিয়েছিল নীরবে।
বিদায়ের দিন অন্বেষা এয়ারপোর্টে যায়নি। সে জানত না, অভিমানটা কতটা গভীর হয়ে উঠেছে নিজের অজান্তে। ভেবেছিল, সৌম্য অন্তত একবার ফোন করবে, একবার খোঁজ নেবে। কিন্তু না—সেদিনের পর সৌম্য আর কোনো যোগাযোগই করল না।
যে মানুষটা সারাদিন একবার কথা না বললে, রাতে ভিডিও কল না করলে ঘুমাতে পারত না, যে মানুষটা সারাদিনে না জানি কতবার কত আছিলায় মেসেজ করত—হঠাৎ করে বিদেশ যাওয়ার পর সব যেন থেমে গেল। এমনকি পুরোনো ফোন নম্বরটাও বদলে দিল সে। অন্বেষা কোনোদিন কল্পনাও করেনি, এমনটাও হতে পারে।
একা হয়ে গেল অন্বেষা—অথচ সে একসময় ভেবেছিল, সৌম্যই হবে তার সেই অবলম্বন, যে নীরব বন্ধনটাকে ভালোবাসার আলোয় ভরিয়ে তুলবে। কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের মাঝে অদৃশ্য এক দেয়াল দাঁড়িয়ে গেল।
তারপর থেকে রাতগুলো অন্যরকম হয়ে উঠল।
রাত জেগে বই পড়া, ডায়েরির পাতায় কান্না লেখা, বারান্দায় দাঁড়িয়ে চাঁদের আলোয় নিজেকে খুঁজে পাওয়া—এই সবই হয়ে উঠল তার একমাত্র সঙ্গী।
একদিন ডায়েরিতে লিখল—
“সে কথা রাখেনি, আমিও আর প্রশ্ন করিনি। শুধু নিজের ভেতরে ভেঙে গেছি, নীরবে।”
এই নীরব যন্ত্রণা তাকে লেখার দিকে টেনে নিল। পুরোনো ডায়েরির পাতাগুলো যেন নতুন করে জীবনের রং পেল। অন্বেষা লিখতে শুরু করল—কবিতা, গল্প, টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতা। নিঃসঙ্গতা, প্রত্যাখ্যান, হাহাকার—সবকিছুই শব্দ হয়ে ঝরে পড়ল কাগজে।
সৌম্য তখনও কোথাও এক প্রান্তে ছিল, কিন্তু এক ছায়ার মতো। অন্বেষা টের পেয়েছিল—এটা ব্যস্ততার অজুহাত নয়, সময়টাই বদলে গেছে। সম্পর্কের ভাষা আর আগের মতো নেই।
পরিচিতদের মধ্যে অনেকেই বলেছিল-
“তুমি খুব বদলে গেছ, অন্বেষা।”
অন্বেষা তাদের কোন উত্তর দেয়নি। তার আর প্রয়োজন ছিল না। সে জানত, বদল নয়—সে ফিরে পেয়েছে নিজেকে।
পাঁচ বছর কেটে যায়।
একদিন কলকাতার এক সাহিত্য সম্মেলনে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত অন্বেষা। তার নতুন বই প্রকাশের অনুষ্ঠান। সভা-সমিতির ভিড়, আলো ঝলমলে মঞ্চ, তুমুল হাততালি। প্যানেল ডিসকাশনে সে দৃঢ় কণ্ঠে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছিল—
“ভালোবাসা কিংবা সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া মানেই শেষ নয়। সেটা নতুন করে বাঁচার এক সূচনা।”
অনুষ্ঠানের শেষে বুকস্টলে দাঁড়িয়ে সই দিচ্ছিল সে। পাঠকেরা একের পর এক এগিয়ে আসছে, বই হাতে, উচ্ছ্বসিত মুখে। হঠাৎ পিছন থেকে ভেসে এল এক পরিচিত কণ্ঠস্বর—
—“অন্বেষা!”
চমকে উঠে তাকালো সে।
তার সামনে দাঁড়িয়ে সৌম্য।
চেহারায় কিছুটা বয়সের ছাপ, চোখে ক্লান্তি, গলায় হালকা কম্পন। পাশে এক নারী—সাধারণ শাড়ি পরা, স্নিগ্ধ মুখে হাসি। সৌম্য পরিচয় করিয়ে দিল,
“এ আমার স্ত্রী। স্কুল মাস্টার।”
অন্বেষা কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল। তার মনে হল, এক মুহূর্তে যেন ফিরে গেছে সেই পাঁচ বছর আগের সন্ধ্যায়, যখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে একা আকাশ দেখছিল। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল।
শান্ত, পরিণত চোখে সৌম্যের দিকে তাকিয়ে বলল—
“অনেক দেরি করে ফিরলে, সৌম্য।”
তার কণ্ঠে ছিল না কোনো অভিমান। ছিল না অভিযোগও। বরং ছিল এক অদ্ভুত শান্তি, এক আত্মবিশ্বাস।
সৌম্য যেন কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু শব্দ খুঁজে পাচ্ছিল না।
আর অন্বেষার চোখে তখন ঝলমল করছিল এক দৃঢ়তা
“সে আর কারও ছায়া হয়ে নয়, নিজেকে পূর্ণ করে বাঁচতে শিখেছে”…..।
ক্রমশ…

