পার্থ প্রতিম চট্টোপাধ্যায়,হলদিয়া,১৬ এপ্রিল : ভারতীয় সংষ্কৃতির অমূল্য সম্পদ হল দুই মহাকাব্য ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’। এই দুই মহাকাব্য তার ঐতিহ্য ও গরিমায় ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে উপনীত হয়েছে সুমহান সাহিত্যের এ আঙিনায়। কিন্তু ভারতীয় সনাতনী হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন শাস্ত্র, পুরাণ, মহাকাব্যে একটি বিশেষ রীতি পরিলক্ষিত হয়। সেই রীতি হল, বাহ্যিক চিত্তাকর্ষক চরিত্র ও কাহিনীর অন্তরালে লুকিয়ে থাকে এক গুপ্ত দর্শন ও সাধন পথ। আপাত দৃষ্টিতে লোমহর্ষক কাহিনী গুলি ভারতীয় সমাজ জীবনের পরতে পরতে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। প্রায় সমগ্র হিন্দু ধর্মের মানুষ এই চরিত্র গুলির পূজা করেন ও কাহিনী গুলির আক্ষরিক অর্থেই মজে থাকেন। হিন্দু শাস্ত্রকারগন সুকৌশলে সাধন পথ ও দর্শনকে লুক্কায়িত রেখেছেন। যাতে অধিকারী ব্যক্তি সাধন দ্বারা সেই পর্যায়ে উন্নীত হয়ে সেই দর্শন জ্ঞাত হতে পারেন ও তার অনধিকারী ব্যক্তিদের দ্বারা অপপ্রয়োগ রোধ হয়। তাই রামায়ণ ও মহাভারত এক অর্থে রূপক মহাকাব্য। যার প্রতিটি চরিত্র কাহিনী সবই রূপক।
গৌরচন্দ্রিকা আর দীর্ঘায়িত না করে মহাকাব্য রামায়ণের “অকাল বোধনের” গুপ্ত সাধন ও দর্শন কথা এই অধমের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আলোচনা করি…
ভগবান শ্রী রামচন্দ্রের অকাল বোধনের কাহিনী আমরা সকলেই জ্ঞাত। রক্ষকুলপতি রাবণকে পরাস্ত করতে শ্রী রামচন্দ্র শরৎ কালে মায়ের অকাল বোধন করেন। অতঃপর মায়ের আশীর্বাদ লাভ করে রাবণকে যুদ্ধে পরাস্ত করেন। এ কাহিনী আমরা অল্প বিস্তর সকলেই জ্ঞাত। কিন্তু এখানে রাম, রাবণ, সীতা, বশিষ্ট, শরৎ, বসন্ত, অকাল বোধন ইত্যাদি প্রতিটিই রূপক। আসুন এবার এই রূপক চরিত্র ও কাহিনীর গুপ্ত রহস্য আলোচনা করি… প্রথমেই আসি “রামের” প্রসঙ্গে:- আদতে আমরা জানি রাম বা রামচন্দ্র হলেন ত্রেতা যুগে ভগবানের অবতার। কিন্তু গুপ্ত অর্থে রাম শব্দের অর্থ হল রমনশীল(আনন্দময়)। অর্থাৎ প্রতিটি রমনশীল স্বরূপ প্রাপ্তির বা আত্মমুক্তির উদ্যেশ্যে সাধনা কারি বীর সাধকই হল রাম।
এই সাধনা কি? এই সাধনা হল সাধকের আত্মশক্তি জাগ্রত করে তার জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন বা রমন। এই সাধনার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন গুরু। আমরা সকলেই জানি শ্রী রামচন্দ্রের গুরু হলেন বশিষ্ট দেব। কিন্তু গুপ্ত ও প্রকৃত অর্থে প্রত্যেক সাধকের গুরুই হলেন বশিষ্ট। প্রতিটি সিদ্ধ গুরুই হলেন বশিষ্ট। কারন “বসোদিষ্ট যষ্মীন স বশিষ্ট:”। অর্থাৎ যার মধ্যে ইষ্টশক্তি বাস করেন তিনিই বশিষ্ট।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাই ভগবান শ্রী কৃষ্ণ অর্জুনকে যে স্বরূপ প্রাপ্তির পথ দেখিয়ে ছিলেন, তাতে তিনি বলেছেন। প্রতিটি জীবই তার গুণের বশবর্তী হয়ে কর্ম করে। এই গুনাশ্রয়ী কর্ম থেকেই কর্মফলের সঞ্চয় হয়। এই কর্ম ও কর্মফলের ভোগের জন্যই, জীবকে বারবার জন্ম নিতে হয়। তাই মোক্ষের পথ হল কর্মত্যাগ। ভগবান আরো বলেন কর্মত্যাগ অর্থে কর্ম করা ছেড়ে দেওয়া নয়, তা হল কর্মফলের ত্যাগ। অর্থাৎ নিষ্কাম ভাবে নিষ্কাম ভাবে ফলের চিন্তা বা আশা না করে গেলে তার কর্ম সমূহ ভস্মীভূত হয়ে সাধকের পরমাত্মায় রমন হয়। এই কর্ম সকল জন্ম জন্মান্তরের ঘূর্ণাবর্তে ভস্মীভূত হতে হতে একসময় যখন সমস্ত কর্ম তথা কর্মফল লয় প্রাপ্ত হয়। তখনই বিন্দুর সিন্ধুতে লয় হয়। একেই বলে কল্পান্ত । আমরা সকলেই জানি বসন্ত কালে হয় মায়ের কাল বোধন ও শরতে মায়ের অকাল বোধন। এখানে ‘বসন্ত’ শব্দটির এখানে প্রকৃত অর্থ …বস্ অর্থে জন্ম জন্মান্তরের কর্মফল ভোগ ও অন্ত অর্থে শেষ। সুতরাং বসন্তের অর্থ হল কল্পান্ত। অর্থাৎ স্বাভাবিক নিয়মে বা কাল অনুসারে জীবের মুক্তি হল বসন্ত বা কল্পান্ত। কিন্তু এই গুরু রূপ বশিষ্টের নির্ধারিত পথে চলে রমনশীল সাধক রাম নির্দিষ্ট কল্পান্তের পূর্বেই, নিজের কর্ম সমূহকে ভস্মীভূত হয়ে সংসার সমুদ্র থেকে পার হতে চান, তখনি হয় মায়ের অকাল বোধন।
‘শরৎ’ শব্দটি এসেছে শৃ ধাতু থেকে। শরৎ অর্থে পরিপক্ক হওয়া। অকালে সাধন দ্বারা পরিপক্ক হওয়ার নাম শরৎ কাল। অকালে সাধন/রমন দ্বারা সাধক দেহ রূপ দুর্গ হতে নির্দিষ্ট কল্পের পূর্বেই মুক্তিপান। তাই এই দুর্গ হতে ত্রাণ পাওয়ার এই সময়ের পূজা হল দুর্গা পূজা। এই রমনশীল সাধকের সাধনার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন তার গুরু নির্দেশিত পথে চলে তার আত্মশক্তির জাগরণ। এই আত্ম শক্তিই হল রমনশীল সাধক বা রামের সীতা। সীতার জন্ম যজ্ঞ কর্ষিত ভূমি থেকে। অর্থাৎ উপযুক্ত যজ্ঞ বা সাধন দ্বারাই দেহ রূপ দুর্গের অভ্যন্তরে জাগ্রত হয় আত্মশক্তি এই আত্মশক্তিই সীতা। এই যজ্ঞ ভূমি হল মুলাধার। সাধন বা কর্ষনের দ্বারা মুলাধার স্থিত কুলকুন্ডলিনি শক্তি বা আত্মশক্তি বা সীতার মিলনই হল নিগূঢ় তত্ত্ব।
রমনশীল সাধকের সাধনার প্রাথমিক পর্যায় হল ইন্দ্রিয়দমন। এই ইন্দ্রিয় গুলি তাদের প্রকৃতি অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়ের দিকে মন কে টেনে নিয়ে যায় । তাই চিত্ত সংযোগ ও স্থিতধী হবার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন ইন্দ্রিয় দমন। এই ইন্দ্রিয়ময় পুরুষই হল রাবণ। এই ইন্দ্রিয় কয় প্রকার? পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয় পাঁচ কর্মেন্দ্রিয় মিলিয়ে দশ। তাই রাবনের দশ মাথা।ভাই দশ ইন্দ্রিয়ের বশবর্তী পুরুষই হলেন রাবণ। বিক্ষোভ রূপ রাব এই ইন্দ্রিয় সকল মনকে চঞ্চল করে। এই রাবের দ্বারা রমনশীল সাধক বা রামের সমাধি ভঙ্গ করে বলেই তার নাম রাবণ। এই ইন্দ্রিয় গুলিই রমনশীল রামের বা সাধকের প্রধান বিরোধী।
এই ইন্দ্রিয় বশীভূত পুরুষ রাবনকে পরাস্ত করতে রমনশীল সাধক(রাম) তার গুরু রূপ বশিষ্টের নির্দেশিত পথে চলে তার নির্দিষ্ট কল্পান্তের পূর্বে বা বসন্তের বহু পূর্বে তার আত্মশক্তি বা সীতাকে জাগ্রত করে অকালে সাধন দ্বারা পরিপক্ক হওয়ার কালে অর্থাৎ শরৎ কালে, দেহ রূপ দুর্গ থেকে ত্রাণ পেতে দুর্গা পূজা করেন অর্থাৎ অকালবোধন করেন। সাধকের জীবত্ব বিনষ্ট হয়ে শিবত্বে বোধন হয়।
এই হল গুপ্ত সাধন পন্থা। হিন্দু ধর্মের যত রকম সাধন পন্থা আছে তা সবই অন্তিম পর্যায়ে কুলকুন্ডলিনি শক্তির মুলাধার থেকে সহস্রারে উত্থানে নিহিত হয়। অকালবোধনের নিগূঢ় তত্ত্বও তাই নির্দেশিত করে। এই রূপক রামায়ণ মহাভারত সহ হিন্দু শাস্ত্রের নিগূঢ় গুপ্ত তত্ত্বকথা না বুঝে শুধু মাত্র আক্ষরিক চরিত্র কাহিনী গল্পে মজে থাকলে অপেক্ষা করতে হবে সেই কল্পান্ত বা বসন্তের কাল বোধনের জন্য। আর যে সকল রমনশীল সাধক রাম রূপ ধরে কল্পান্তের বহু পূর্বেই তাদের সীতা রূপ আত্মশক্তিকে জাগ্রত করে পরিপক্ক হবেন তারাই করবেন অকাল বোধন।।