শ্যামসুন্দর ঘোষ,মেমারী(,পূর্ব বর্ধমান),০৩ জানুয়ারী : ফের দেনায় দায়ে হতাশায় আত্মঘাতী হলেন পূর্ব বর্ধমান জেলার এক কৃষক । এবারে ঘটনাটি ঘটেছে মেমারী থানার পাহাড়হাটি গ্রামে । পুলিশ জানিয়েছে, মৃতের নাম ভাস্কর মণ্ডল ( ৫৩ ) । সোমবার ভোরে বাড়ির একটি ঘরে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ভাস্করবাবুকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পান তাঁর স্ত্রী রীনাদেবী । তাঁর চিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা ছুটে এসে তাঁকে নামিয়ে তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যায় । কিন্তু চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন । পরে মৃতদেহটি ময়নাতদন্তের জন্য পাঠায় পুলিশ । মৃতের পরিবারের দাবি,ভাস্করবাবু এবারে আলু চাষের জন্য সমবায় ব্যাঙ্ক ও মহাজন মিলিয়ে প্রায় আড়াই তিন লক্ষ টাকা দেনা করেছিলেন । কিন্তু ঘুর্ণীঝড় জাওয়াদের কারনে জমিতে জল জমে সমস্ত আলু গাছ নষ্ট হয়ে যায় । তার জেরেই ভাস্করবাবু হতাশায় আত্মঘাতী হয়েছেন বলে দাবি করেছেন তাঁর পরিবারের লোকজন ।
জানা গেছে,পাহাড়হাটি গ্রামের বাসিন্দা পেশায় কৃষক ভাস্কর মণ্ডলের বাড়িতে রয়েছেন বৃদ্ধ বিধবা মা বনমালা মণ্ডল,স্ত্রী রীনাদেবী । ভাস্করবাবুর দুই মেয়ে রিম আর রানুর আশপাশের গ্রামে বিয়ে হয়েছে । অল্পসল্প জমিজমাতে চাষবাস করে সেই উপার্জনে সংসার চালানোর পাশাপাশি অতিকষ্টে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন ভাস্করবাবু । এবারেও তিনি বেশ কয়েক বিঘা জমিতে আলু বীজ রোপন করেছিলেন । মৃতের সম্পর্কীয় ভাই স্বরূপ মণ্ডল বলেন, ‘আলু চাষ করার জন্য সমবায় ব্যাঙ্ক থেকে কৃষিঋণ নিয়েছিলেন দাদা । সেই সঙ্গে কয়েকজন স্থানীয় মহাজনের কাছ থেকেও তিনি বেশ কিছু দেনা করেছিলেন । ইতিমধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারনে প্রচন্ড বৃষ্টিপাত হয় । ফলে আলু জমিতে জল জমে যায় । তখন সদ্য আলুগাছ বড় হচ্ছিল । কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে জমিতে জল জমে থাকায় সমস্ত গাছের গোঁড়া পচে যায় । এদিকে দেনা শোধের জন্য তাগাদাও শুরু হয়েছিল । ফলে সংসার চালিয়ে কিভাবে ওই দেনা শোধ করবেন তা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় ভুগছিলেন দাদা । কিন্তু শেষ পর্যন্ত দাদা যে এমন ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নেবেন কল্পনাও করিনি ।’
স্থানীয় ও পরিবার সুত্রে জানা গেছে,জমিতে আলু গাছ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর অর্থাভাবের কারনে আর নতুন করে আলু রোপন করতে পারেননি ভাস্করবাবু । পরিবর্তে তিনি সমস্ত জমি গ্রামের এক কৃষককে ভাগে দিয়ে দেন । কিন্তু দেনা শোধ ও তিন জনের সংসার চালানোর চিন্তায় তিনি এতটাই হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলেন যে মাঝে মধ্যে অর্ধ উন্মাদের মত আচরন করতে শুরু করেছিলেন বলে জানিয়েছেন গ্রামবাসীরা । শেষে এদিন ভোরে বাড়িতে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মঘাতী হন ভাস্করবাবু । মৃতের স্ত্রী রীনাদেবী জানিয়েছেন, এদিন তিনি ও তাঁর স্বামী একসঙ্গে ঘুম থেকে ওঠেন । প্রতিদিনের মত তিনি সংসারের কাজকর্ম করতে শুরু করেন । সেই সময় বাড়ির একটি ঘরে ঢুকতেই তাঁর স্বামীকে তিনি ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পান ।
এখন অশীতিপর শাশুড়িকে নিয়ে কার্যত পথে বসেছেন মৃতের স্ত্রী রীনা মণ্ডল । ওই অসহায় পরিবারটিকে সরকারি সাহায্যের ব্যাবস্থা করার জন্য দাবি জানিয়েছেন গ্রামবাসীরা । প্রসঙ্গত,গত বৃহস্পতিবার পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনা ২ ব্লকের বৈদ্যপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ওসমানপুর গ্রামের বাসিন্দা পান্নালাল মুদিরায়(৫৬) নামে এক কৃষক গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মঘাতী হয়েছিলেন । তাঁরও আলু জমি ঘুর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে হওয়া বৃষ্টিপাতের জেরে ডুবে গিয়েছিল বলে জানা গেছে । ফলে সমস্ত আলুগাছ নষ্ট হয়ে যায় । সেই ক্ষতি সামলাতে পেরেই তিনি হতাশায় আত্মঘাতী হয়েছেন বলে দাবি করেছেন পরিবারের লোকজন । এভাবে একের পর এক কৃষক আত্মঘাতী হওয়ায় ব্যাপক চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে শস্যগোলা বর্ধমানে ।
যদিও জেলা পরিষদের কৃষি কর্মাধ্যক্ষ মহম্মদ ইসমাইল দাবি করেছেন,চাষের কারণে ভাস্কর মণ্ডল আত্মঘাতী হননি । তিনি মানসিক রুগী ছিলেন ।একই দাবি করেছেন,জেলার সহ কৃষি আধিকারিক জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় ।
তবে কৃষি আধিকারিক এমনটা দাবি করলেও কৃষি দফতর সূত্রে খবর,সম্প্রতি হওয়া অসময়ের বৃষ্টিতে মেমারি ২ ব্লকে চাষের ভালোই ক্ষতি হয়েছিল । ১৭ হাজার হেক্টর আমন ধানের মধ্যে প্রায় ৭ হাজার হেক্টর ধান ক্ষতির মুখে পড়ে। এছাড়াও ৮৬০০ হেক্টরের আলু চাষের মধ্যে ৫২০০ হেক্টর আলু চাষের জমি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল । তার মধ্যে মেমারি ২ ব্লকের পাহারহাটি এলাকায় ক্ষতির পরিমান বেশ ভালোই হয়েছিল বলে জানা গেছে ।।