প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,০৩ ফেব্রুয়ারী : মেধাবী ছেলেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল বাবার। কিন্তু তা আর হয়নি। পরীক্ষা শুরুর একদিন আগে সেরিব্রাল স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে বাবা মারা যান ।বাবার মুখাগ্নি সারা সেই ছেলে সোমবার বাবাকে ছাড়াই ’কাছা’পরিহিত হয়ে পৌছেযায় পূর্ব বর্ধমানের মন্তেশ্বরের মালডাঙা আর এম ইনস্টিটিউশন পরীক্ষা কেন্দ্রে।মেধাধী ছাত্র স্বর্ণাভ চট্টোপাধ্যায়ের এই মানসিক দৃঢ়তাকে তাঁর সহপাঠী ও স্কুলের শিক্ষকরা কূর্নিশ জানিয়েছে। স্বর্ণাভর সাফল্য কামনাও করেছেন।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী স্বর্ণাভ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি মন্তেশ্বর গ্রামে।সেখানকার সাগরবালা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র স্বর্ণাভ।তাঁর বাবা মলয় চট্টোপাধ্যায় কলকাতার একটি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। সেরিব্রাল স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে কয়েকদিন আগে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।তাঁকে বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার রাত সাড়ে-৯টা নাগাদ সেখানেই মলয় চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয় ।
বাবা মারা যাওয়ার খবর শনিবার রাতেই পৌছায় স্বর্ণাভর বাড়িতে। বাড়ির লোকজনের কাছে বাবার মৃত্যু হওয়ার কথা জেনে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছেলে স্বর্ণাভর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। স্বামীর মৃত্যুতে শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন স্বর্ণাভর মা মৌসুমী দেবী। রবিবার দুপুরে নবদ্বীপ শ্মশাণ ঘাটে মলয় চট্টোপাধ্যায়ের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় । বাবার মুখাগ্নি সারে ছেলে স্বর্ণাভ।বাবাকে চিরতরে হারানোর শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়লেও স্বর্ণাভ তাঁর বাবার স্বপ্নপূরণের জন্য মানসিক ভাবে নিজেকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তোলে। বাবার মুখাগ্নি সেরে বাড়িতে ফিরে শোকের ছায়ায় ভরা বাড়িতে বসেই সে শুরু করে দেয় বইয়ের পাতায় চোখ বুলানো ।
বাবার মুখাগ্নি সারার পর রাত পেরিয়ে সকাল হতেই স্বর্ণাভ পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে দেয়। সাদা কাপড়ের ‘ কাছা’ পরিহিত হয়ে সোমবার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই স্বর্ণাভ পৌছে যায় পরীক্ষাকেন্দ্র মালডাঙার আর এম ইনস্টিটিউশনে। সহপাঠীদের সঙ্গে সেও এদিন বাংলা পরীক্ষা দেয় । পরীক্ষা শেষে বাইরে বেরিয়ে স্বর্ণাভ জানায়,তাঁর পরীক্ষা ভাল হয়েছে। বাবার স্বপ্ন পূরণের জন্য সবকটা পরীক্ষা তাঁকে ভালভাবে দিতেই হবে। কি ছিল বাবার স্বপ্ন ? এই প্রশ্নের উত্তরে স্বর্ণাভ বলে,’আমি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করবো,এই স্বপ্ন আমার বাবা দেখতেন। কলকাতার নামী কলেজে আমাকে ভর্তি করারও স্বপ্ন ছিল আমার বাবার। আমার বাবা আজ আর নেই । তবে আমাকে নিয়ে আমার যে স্বপ্ন ছিল সেই স্বপ্নের কথা আমি ভুলে যাই নি , ভুলতে চাইও না। তাই বাবাকে হারানোর শোক বুকে নিয়েই বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে এদিন ’কাছা’ পরেই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে গিয়েছি। বাকি পরীক্ষা গুলোও দিতে যাব।’
স্বর্ণাভর মা মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় এদিন চোখের জল মুছতে মুছতেই বলেন,“স্বর্ণাভ ছোট থেকেই পড়াশুনায় ভাল।তার কারণে ছেলে কে নিয়ে আমার স্বামীর অনেক স্বপ্ন ছিল ।ছোট থেকে বাবার হাত ধরেই ছেলে পরীক্ষা দিতে যেত । এবার বাবাকে ছাড়াই ছেলেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে যেতে হঢ় । উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর ছেলেকে কলকাতার নামী কলেজে ভর্তি করে পড়াবেন বলে আমার স্বামী আগে থেকেই কলকাতায় একটি ঘর ভাড়া নিয়ে রেখে ছিলেন।কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার আগেই আমার স্বামী অকালে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। এর থেকে বড় বেদনার আর কি হতে পারে!