জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,গলসি(পূর্ব বর্ধমান),১৬ ডিসেম্বর : করোনার পর বিদ্যালয় বিমুখ ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ে ফেরানোর সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে এগিয়ে এলেন গলসি- ২ ব্লকের সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক সঞ্জীব সেন, গলসী পূর্বের বিদ্যালয় পরিদর্শক জয়ন্ত ঢালি ও পশ্চিমের দেবকুমার ভক্ত । তাঁদের সঙ্গে ছিলেন আদ্রাহাটি বি.এস শিক্ষা নিকেতনের প্রধান শিক্ষক কার্তিক চন্দ্র নাগ, বেলান উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক অসীম বিশ্বাস, শিক্ষাকর্মী ও বিদ্যালয়ের সভাপতি । এই অসাধারণ দৃশ্যের সাক্ষী থাকল গলসিবাসী ।
২০১৯ সালের শেষের দিকে চীনের সীমান্ত অতিক্রম করে করোনা যখন মহামারী থেকে অতিমারিতে পরিণত হয়ে গোটা বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর তাণ্ডব লীলা শুরু করে, আতঙ্কিত জনগণ তখন গৃহবন্দী হয়ে পড়ে । গোটা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের প্রতিটি রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় । দেশের কয়েকটি রাজ্য বিদ্যালয় চালু করার চেষ্টা করলেও সেই সব বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একটা অংশ করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়লে একদিকে করোনা আতঙ্ক ও অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে পুনরায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ হয়ে যায় ।
করোনা অতিমারির জন্য গত প্রায় কুড়ি মাস ধরে গোটা দেশের সঙ্গে সঙ্গে এরাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিও বন্ধ ছিল। পরিস্থিতি খানিকটা স্বাভাবিক হলে সরকারি নির্দেশে গত ১৬ ই নভেম্বর থেকে বিদ্যালয় চালু হয় । যদিও সমস্ত শ্রেণির নয়, নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান শুরু হয় এবং সেটা সপ্তাহে ছ’দিনের পরিবর্তে পাঁচদিন। বিদ্যালয় শুরু হওয়ার আগে ছেলেমেয়েদের নিরাপত্তার স্বার্থে শ্রেণিকক্ষ সহ সমস্ত বিদ্যালয় স্যানিটাইজ করা হয় এবং আতঙ্ক দূর করার জন্য প্রচারও করা হয় । তাসত্ত্বেও করোনা আতঙ্কে উপস্থিতির হার পর্যাপ্ত হচ্ছিল না। অন্যদিকে ধান কাটার মরশুমে বাড়তি আয়ের আশায় গ্রাম বাংলার গরীব ঘরের ছেলেরা চলে গেছে ধান কাটতে । অন্যদিকে নজরদারির অভাবে অনেক নাবালিকা মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় । রাজ্যের অন্যান্য বিদ্যালয়ের মত গলসী ২ নং ব্লকের বিভিন্ন উচ্চ বিদ্যালয়ের উপস্থিতির হার খুব একটা আশাপ্রদ নয় ।
বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বহু চেষ্টা করেও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় ১৫ ই ডিসেম্বর গলসী পূর্বের বিদ্যালয় পরিদর্শক জয়ন্ত ঢালি ও পশ্চিমের পরিদর্শক দেবকুমার ভক্তকে সঙ্গী করে সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক সঞ্জীব সেন চলে যান স্থানীয় আদ্রাহাটি বি.এস শিক্ষা নিকেতনের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী পায়েল বাগদি এবং বেলান বিল্বেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী অনিতা রুইদাস ও সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র প্রদীপ রুইদাসসহ মোট ছ’জন ছাত্রছাত্রীর বাড়িতে । বিদ্যালয় সূত্রে জানা যাচ্ছে,করোনা ভীতি কাটিয়ে গত ১৬ ই নভেম্বর বিদ্যালয় পুনরায় চালু হওয়ার পর এইসব ছাত্রছাত্রীদের মত আরও কয়েকজন একদিনের জন্যেও বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়নি । তাই তাদের বিদ্যালয়মুখী করার জন্য প্রশাসনিক আধিকারিকরা এগিয়ে এলেন। সঙ্গে থাকলেন বিদ্যালয় দুটির শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা । আতঙ্কিত না হয়ে ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর জন্য তারা অভিভাবকদের অনুরোধ করেন। চোখের সামনে উচ্চ পদস্থ আধিকারিক এবং শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মীদের দেখে অভিভাবকরা চমকে যান । তারা তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেন । প্রশাসনিক আধিকারিকদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন গ্রামবাসী ও স্থানীয় শিক্ষামহল ।
এস.আই জয়ন্ত ঢালি বলেন, ‘বিদ্যালয় চালু হলেও ঠিকমত ছেলেমেয়েরা বিশেষ করে মেয়েরা বিদ্যালয়ে আসছিল না । তাই বিডিও সাহেবের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের বিদ্যালয়মুখী করার জন্য পাড়ায় পাড়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই । আশাকরি আগামী দিনে ছেলেমেয়েদের উপস্থিতি বাড়বে । একই কথা বললেন অপর এস.আই দেবকুমার ভক্ত। তারও আশা এইসব পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে বিদ্যালয়গুলিতে উপস্থিতির হার বাড়বে ।
অন্যদিকে সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক সঞ্জীব সেন বলেন, ‘খবর পাচ্ছিলাম বিদ্যালয় চালু হলেও উপস্থিতির হার যথেষ্ট ছিল না। বিশেষ করে মেয়েরা বিদ্যালয়ে কম আসছে । অথচ বিদ্যালয়গুলির পক্ষ থেকে চেষ্টার ত্রুটি ছিলনা । পরিস্থিতি উপলব্ধি করে প্রশাসনিক কাজের শেষে পূর্ব ও পশ্চিমের বিদ্যালয় পরিদর্শক এবং শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের বাড়িতে বাড়িতে যাই । নিয়মিত প্রশাসনিক কাজের শেষে বের হয়েছিলাম তাই সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল এবং খুব বেশি বাড়িতে যেতে পারিনি ।আগামী দিনে আরও বেশি জনের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করব ।’
প্রসঙ্গত,সঞ্জীব বাবু কয়েকদিন আগেও গলসী পূর্বের বিদ্যালয় পরিদর্শককে সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় একটি বালিকা বিদ্যালয়ের বিদ্যালয় বিমুখ ছাত্রীদের বিদ্যালয়ে ফেরানোর চেষ্টা করে সফল হন। সবার আশা এবারও তিনি সফল হবেন । আধিকারিকদের মহতী উদ্যোগের কথা জানতে পেরে গলসী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ( সম্প্রতি তিনি অন্য বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন ) তাঁদের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, ‘এই ধরনের উচ্চ পদস্থ আধিকারিকরা বিদ্যালয় বিমুখ ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়মুখী করার চেষ্টা করলে তার সুফল পাওয়া যাবেই । বাড়ি বাড়ি তাদের যাওয়ার খবর সমস্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগবে না । ফলে অভিভাবকরাও ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর জন্য সচেষ্ট হবেন ।।