সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ও তার দোসর আমেরিকা স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত৷ যা আজও অব্যাহত আছে । অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আজকের রাশিয়া পর্যন্ত ওই পশ্চিমা অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে বারবার ভারতের ঢাল হয়ে সামনে এসেছে । অর্ধ শতাব্দীর অধিক সময় আগে, ১৯৭১ সালে আমেরিকা-ব্রিটেনের যৌথ হামলা থেকে ভারতকে রক্ষা করেছিল রুশ সাবমেরিন । যে কাহিনী আজও ভারত-রুশ বন্ধুত্বের প্রতীক হয়ে আছে ।
১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, যা তৃতীয় ভারত-পাক যুদ্ধ নামেও পরিচিত,স্থায়ী হয়েছিল ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত৷ ভারত ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এর মধ্যে সংঘটিত একটি সামরিক সংঘাত। এই যুদ্ধটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ঘটেছিল এবং এর ফলস্বরূপ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পাকিস্তান তখন পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে৷ হঠাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে যুদ্ধ বন্ধ করার হুমকি দেয় । উদ্বিগ্ন ভারত একটি SOS পাঠায় সোভিয়েত ইউনিয়নে । ভারতীয় ইতিহাসের বই থেকে প্রায় মুছে ফেলা একটি কাহিনী যা প্রতিটা দেশপ্রেমীর জানা উচিত ।
১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় যখন নিশ্চিত, তখন রিচার্ড মিলহাউস নিক্সনকে পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরী USS এন্টারপ্রাইজের নেতৃত্বে মার্কিন সপ্তম নৌবহর টাস্ক ফোর্সকে বঙ্গোপসাগরে পাঠানোর জন্য চাপ দেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। ১৯৭০-এর দশকে ৭৫,০০০ টনের ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ ছিল বিশ্বের বৃহত্তম পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরী, যেখানে ৭০টিরও বেশি যুদ্ধবিমান ছিল। সমুদ্রের তলদেশে কার্যত এক বিশাল দৈত্য। ভারতীয় নৌবাহিনীর বহরের নেতৃত্বে ছিল ২০,০০০ টনের বিমানবাহী রণতরী বিক্রান্ত, যেখানে ২০টি হালকা যুদ্ধবিমান ছিল।
বঙ্গোপসাগরে ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ পাঠানোর আনুষ্ঠানিক কারণ ছিল বাংলাদেশে আমেরিকান নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়া, যদিও অনানুষ্ঠানিকভাবে এটি ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ভয় দেখানো এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা রোধ করা। শীঘ্রই ভারত আরেকটি খারাপ খবর পেল।
সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা ভারতকে জানায় যে, বিমানবাহী রণতরী এইচএমএস ঈগলের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী ব্রিটিশ নৌবহর, কমান্ডো রণতরী এইচএমএস অ্যালবিয়ন সহ, অসংখ্য ডেস্ট্রয়ার এবং অন্যান্য জাহাজ নিয়ে পশ্চিম দিক থেকে আরব সাগর পেরিয়ে ভারতীয় জলসীমার দিকে এগিয়ে আসছে।
ব্রিটিশ এবং আমেরিকানরা ভারতকে ভয় দেখানোর জন্য একটি সমন্বিত নৌ আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিল : আরব সাগরে ব্রিটিশ জাহাজগুলি যখন ভারতের পশ্চিম উপকূলকে নিশানা করবে, তখন আমেরিকানরা চট্টগ্রাম আক্রমণ করবে । ভারতীয় নৌবাহিনী ব্রিটিশ এবং আমেরিকান জাহাজের মধ্যে আটকা পড়েছিল।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাস ছিল, এবং বিশ্বের দুটি শীর্ষস্থানীয় গণতন্ত্র এখন বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ ছিল। দিল্লি থেকে মস্কোতে একটি SOS পাঠানো হয়েছিল। লাল নৌবাহিনী শীঘ্রই ভ্লাদিভোস্টক থেকে ১৬টি সোভিয়েত নৌ ইউনিট এবং ছয়টি পারমাণবিক সাবমেরিন পাঠায় USS এন্টারপ্রাইজকে আটকাতে। ভারতীয় নৌবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান অ্যাডমিরাল এন কৃষ্ণান তার ‘নো ওয়ে বাট সারেন্ডার’ বইতে লিখেছেন যে তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে আমেরিকানরা চট্টগ্রামে পৌঁছাবে।তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে কীভাবে তিনি এন্টারপ্রাইজকে ধীর করার জন্য ‘করো অথবা মরো’ পদক্ষেপে আক্রমণ করার কথা ভেবেছিলেন।
১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর, মার্কিন সপ্তম নৌবহরের টাস্ক ফোর্স, যার নেতৃত্বে ছিল তুমুল গতিতে যুদ্ধরত ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ, বঙ্গোপসাগরে পৌঁছায়। ব্রিটিশ নৌবহর আরব সাগর থেকে এগিয়ে আসছিল। বিশ্ব নিঃশ্বাস বন্ধ করে রেখেছিল। কিন্তু, আমেরিকানরা তখনো টের পায়নি যে ডুবে থাকা সোভিয়েত সাবমেরিনগুলি তাদের অতিক্রম করে ফেলেছে ।
ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ যখন পূর্ব পাকিস্তানের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন সোভিয়েত সাবমেরিনগুলি কোনও সতর্কতা ছাড়াই ভেসে ওঠে। সোভিয়েত সাবমেরিনগুলি এখন ভারত এবং মার্কিন নৌবাহিনীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল। এতে আমেরিকানরা হতবাক হয়ে যায় । সপ্তম মার্কিন নৌবহরের কমান্ডার অ্যাডমিরাল গর্ডনকে বললেন: “স্যার, আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি। সোভিয়েতরা এখানে এসেছে! পিছু হটা ছাড়া আর কোন উপায় নেই ।” অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটিশ উভয় নৌবহরই পিছু হটে।
আজ, বেশিরভাগ ভারতীয় বঙ্গোপসাগরে দুই পরাশক্তির মধ্যে এই বিশাল নৌ দাবার লড়াই ভুলে গেছে । কিন্তু এই কাহিনী আমাদের মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ । যেকারণে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ওই কাহিনীর ইঙ্গিত দিয়ে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, যে ১০০ জন নতুন বন্ধুর চেয়ে একজন পুরনো বন্ধু ভালো । অর্থাৎ ভারতের কখনোই সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধুত্বের কথা ভোলা উচিত নয় ।।