প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,২৪ ডিসেম্বর : শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় পাশ করেও দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিতই রয়ে থাকতে হয়েছে।তারই প্রতিবাদ স্বরুপ কলকাতায় গান্ধী মুর্তির পাশের ধরনামঞ্চে বসে নিজের মস্তকমুণ্ডন করেছেন বঞ্চিত চাকরি প্রার্থী রাসমণি পাত্র।শিক্ষিকা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর উচ্চ শিক্ষিতা রাসমণির এহেন প্রতিবাদ বঙ্গ রাজনীতি তে তোলপাড় ফেলে দেয়।আর এর পরেই প্রকাশ্য আসে ’টেট’ উত্তীর্ণ হয়েও শিক্ষিকা না হতে পারার আক্ষেপ বুকেনিয়ে এক উচ্চ শিক্ষিতার জীবনযুদ্ধে হার মানার বেদনাতুর কাহিনী।মুনমুন ঘোষ নামে ওই কর্মপ্রার্থীর আক্ষেপ পূরণের জন্য তাঁর স্বামী এখন তাঁদের একমাত্র মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করে তোলার কঠিন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।যে সংগ্রামের কাহিনীই হয়তো আগামী দিনের হবু শিক্ষকদের কাছে প্রেরণার অন্যতম ভিত্তি হয়ে উঠবে।
স্কুল জীবন থেকেই লেখা পড়ায় নিজের মেধার পরিচয় দিয়ে গেছেন মুনমুন ঘোষ। পূর্ব বর্ধমানের মন্তেশ্বর থানার উজনা গ্রামের এক প্রান্তিক চাষি পরিবারের মেয়ে মুনমুন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ’মাস্টার’ ডিগ্রী (এম এ) অর্জন করেন।পাশাপাশি সাফল্যের সঙ্গে তিনি “বি-এড’
কোর্সও সম্পূর্ণ করেন।তাঁর স্বপ্ন ছিল স্কুল শিক্ষিকা হওয়ার।সেই স্বপ্ন নিয়েই তিনি ২০১৪ সালে প্রাইমারি ’টেট’ পরীক্ষা দেন। তাতে তিনি কোয়ালিফাইও করেন।তার পর থেকেই তিনি চাকরি হয়ে যাবার আশায় বুকবেঁধে ছিলেন।
এরই মধ্যে আর পাঁচটা বাবা মায়ের মত মুনমুনের বাবা মাও তাঁদের মেয়েকে পাত্রস্থ করার ব্যাপারে মনস্থির করে ফেলেন।সেইমত ২০১৯ সালে জেলার জামালপুর থানার জাঙ্গীরপুর গ্রামের চাষি পরিবারের যুবক সুব্রত খোরটের সঙ্গে তার বিয়ে হয় ।২০২০ সালে মুনমুন কন্যা সন্তানের মা হন । সেই কন্যা সুনয়নার বয়স এখন চার বছর ছুঁই ছুঁই।সে এখন স্থানীয় অঙ্গনওয়াড়ির স্কুলে ’বর্ণ পরিয়ের’ পাঠ নিচ্ছে।
সুব্রত জানান,তিনি তাঁর স্ত্রী মুনমুনের মত উচ্চ শিক্ষিত নন। বরং তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা যে মুনমুনের থেকে অনেক কম তা সুব্রত অকপটে স্বীকার করে নেন। সুব্রত এও বলেন,’আমার পরিবারের আর্থিক অবস্থাও ভালো নয়। আমি আর আমার বাবা নিমাই খোরট মিলে পারিবারিক চার বিঘা জমি চাষ করি। তা থেকে সামান্য যে অর্থ উপার্জন হয় তা দিয়েই আমাদের সংসার চলে ।তবে এ নিয়ে আমার স্ত্রীর মুনমুনের কোন আক্ষেপ ছিলনা। প্রাইমারি ’টেট’ পরীক্ষায় ’কোয়ালিফাই’
করার পর যেহেতু একবার ২০১৬ সালে এবং তার পর ২০২১ সালের প্রথম দিকে ’ভাইবা’ হয়ে গিয়েছিল,তাই মুনমুনের প্রত্যাশা ছিল তাঁর চাকরিটা হবেই।চাকরির বেতনের অর্থে নিজের মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে উচ্চ শিক্ষিত করা ও সংসারের শ্রীবৃদ্ধি ঘটানোর ইচ্ছা বারে বারে মুনমুন প্রকাশ করতো। কিন্তু বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও তা না হওয়ায় মুনমুনের আক্ষেপের অন্ত ছিল না ।
আক্ষেপ বুকে নিয়েই মুনমুন তাঁর স্বামী,শ্বশুর,
শাশুড়ি ও মেয়েকে নিয়ে সংসার সামলাচ্ছিলেন।
তারই মধ্যে হঠাৎ করে ২০২১ সালের মাঝামাঝি সনয়ে মুনমুনের জীবনে নেমে আসে এক ঘোর বিপদ। সুব্রত জানান ,’তখন দেশজুড়ে করোনা অতীমরির দাপট চলছে।ওই বছরের জুন মাসে হঠাৎ করেই একদিন মুনমুন জ্বরে আক্রান্ত হয়।চিকিৎসার জন্যে তাকে ডাক্তার বাবুর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।কিন্তু ওষুধ খেয়েও জ্বর কমে না।এদিকে জ্বরের মধ্যেই আবার তার শ্বাসকষ্টও শুরু হয় মুনমুনের ।এই অবস্থায় আর কোন ঝুঁকি না নিয়ে তাঁরা মুনমুনকে বর্ধমানের একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করেন। সেখানে টানা ১৫ দিন চিকিৎসা চললেও শেষ রক্ষা হয় নি। ওই বছরে ১৩ জুলাই মাত্র ৩০ বছর বয়সে মুনমুন জীবন যুদ্ধে হার মানে।
মুনমুনদেবী যখন মারা যান তখন তাঁর মেয়ে সুনয়নার বয়স মাত্র দেড় বছর মাত্র । সেই থেকে মাতৃহারা শিশুকন্যা সুনয়নাকে পরম স্নেহে লালন
পালন করে চলেছে তাঁর দাদু নিমাই খোরট, ঠাকুমা কল্পনাদেবী ও বাবা সুব্রত। কল্পনাদেবী বলেন, “আমার বৌমা রুপে ছিল লক্ষ্মী , আর গুনে ছিল সরস্বতী।কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আর বঞ্চনার কারণে ’টেট’ উত্তীর্ণ অনেক যোগ্য চাকরি প্রার্থীর মত আমার বৌমারও স্কুল শিক্ষিকা হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয় নি। সেই আক্ষেপ বুকে নিয়েই অকালে আমার বৌমাকে চলে যেতে হল“ ।কল্পনাদেবী ও নিমাইবাবু একই সুরে বলেন ,“বৌমার আক্ষেপ যাতে তাঁর মেয়ে পূরণ করতে পারে সেই জন্যে তাঁরা তাঁদের নাতনিকে উচ্চ শিক্ষিত করতে চান।আমার ছেলে সুব্রতও তাই চায় । এখন নাতনি বর্ণ পরিচয়ের পাঠ নিচ্ছে।বৌমা যেহেতু গান বাজনা ভালো বাসতো তাই নাতনিকে একটা হারমোনিয়াম কিনে দেওয়া হয়েছে। ইচ্ছা রয়েছে ভাল নামজাদা স্কুলে নাতনি সুনয়নাকে ভর্তি করার। কিন্তু বাধ সেজেছে সংসারের আর্থিক অনটন ।
এদিকে এইসব কথার ফাঁকেই কল্পনাদেবী রাজ্যের শাসক দলের উদ্দেশ্যে একরাশ ক্ষোভ উগরে দেন।
তিনি বলেন ,“২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমি তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী হয়ে ভোটে লড়ে জয়ী হই ।দীর্ঘ পাঁচ বছর আমি জ্যোৎশ্রীরাম গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্বাচিত সদস্য ছিলাম। আমার ছেলে সুব্রত বাম আমল থেকে সক্রিয় ভাবে তৃণমূল ক্ংগ্রেস পার্টিটা করছে । তাই বৌমার চাকরিটা যাতে হয়ে যায় আমি আর আমার ছেলে দলের অনেক নেতা , সাংসদ ও বিধায়কের কাছে অনুরোধ রেখেছিলাম । কিন্তু কেউ পাত্তা দেয় নি। এমনকি নাতনির ভবিষ্যৎতের কথা ভেবে আমার ছেলেকে একটা কাজের ব্যবস্থা করো দেওয়ার জন্যেও দলের নেতাদের কাছেও অণুরোধ করেছিলাম।কিন্তু সব নেতাদের কাছ থেকে শুধু প্রত্যাখ্যানই মিলেছে“। আর সুব্রতও তাঁর ক্ষোভ চেপে না রেখে বলেন, তৃণমূলের নেতারা এখন দলের পুরোনো কর্মীদের প্রত্যাখ্যানই করছেন। তবে আমি সংকল্প করেছি,যত কষ্টই হোক কায়িক পরিশ্রম করে অর্থ জোগাড় করে আমি আমার মেয়ে সুনয়নাকে উচ্চ শিক্ষিত করবোই। কেননা ’টেট’ উত্তীর্ণ হয়েও আমার স্ত্রীর স্কুল শিক্ষিকা না হতে পারার আক্ষেপ আমার মেয়েকেই পূরণ করতে হবে ।
এ সব শুনে জামালপুরের বর্তমান তৃণমূল বিধায়ক
অলক মাঝি অবশ্য দলের অন্য নেতাদের মত
প্রত্যাখ্যানের পথে হাঁটেন নি। বরং তিনি সহমর্মিতা দেখিয়ে সুব্রত ও তাঁর মেয়ের পাশে দাঁড়াবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। এমনকি দলের পুরোনো এই কর্মীর বাড়িতে গিয়েও সনস্যার বিষয়ে খোঁজ খবর নেবেন বলে জানিয়েছেন ।।