প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৭ এপ্রিল :জন্মেছিলেন মহিলা পরিচয় নিয়ে । যুবতী বয়সে সেই মহিলার বিয়ে হয় এক স্কুল মাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে।স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে দীর্ঘ সংসার জীবন কাটানো রেখা চ্যাটার্জী নামের সেই মহিলা বার্ধক্যে পৌছে বনে গিয়েছেন পুরুষ। তবে অবশ্য শারীরিক গঠনে নয়,ভারতীয় নগরিকত্ব পরিচয়পত্র ’আধার’ কার্ডে রেখাদেবীকে পুরুষ (Male) বলে উল্লেখ করা হয়েছে।আর তাতেই বেজায় চটেছেন রেখাদেবী ও তাঁর আইনজীবী দুই পুত্র।দেশের একজন প্রবীন নগরিকের সঙ্গে এমন অভব্যতা কিছুতেই তারা মেনেনিতে পারছেন না।আইনি পথে কি ভাবে এইসব কাজ কারবার বন্ধ করা যায় সেই ব্যাপারে প্রস্তুতি নিচ্ছেন রেখাদেবীর পুত্ররা।
সত্তরোর্ধ্ব প্রবীণা রেখা চ্যাটার্জীর বাড়ি পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর থানার পাঁচড়া গ্রামে। বর্ধিষ্ণু পরিবার তাঁদের।রেখাদেবীর স্বামী গুরুদাস চ্যাটার্জী (৯৩) কয়েক মাস আগে প্রয়াত হয়েছেন । গুরুদাস বাবু স্কুল শিক্ষক ছিলেন। রেখাদেবীর দুই পুত্র রবিশংকর চ্যাটার্জী ও উদয়শংকর চ্যাটার্জী কলকাতা হাইকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী।এহেন
এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের বধূ রেখাদেবীকে কোন যুক্তিতে আধার কার্ডে পুরুষ বলে উল্লেখ করা হল
তার কোন ব্যাক্ষ্যা খুঁজে পাচ্ছেন না পাঁচড়া গ্রামের বাসিন্দারা। তারা এই ঘটনার জন্য নবগ্রাম পোস্ট অফিসে আধার কার্ড তৈরির দায়িত্বে থাকা লোক জনকেই দায়ী করেছেন।
রেখাদেবী জানিয়েছেন,আধার কার্ড বাধ্যতা মূলক হওয়ার পর নিজের আধার কার্ড করানোর জন্য তিনি সমস্ত নথিপত্র নিয়ে স্থানীয় নবগ্রাম পোস্ট অফিসে যান। সেখানে নির্দিষ্ট আবেদন পত্র পুরণ করে ও ফিজ জমা দিয়ে তিনি সমস্ত প্রক্রিয়া সেরে আসেন।এরপর ডাকযোগে তাঁর বাড়িতে আধার কার্ড আসে। রেখাদেবী বলেন,ওই আধার কার্ড হাতে নিয়ে দেখতেই তাঁর চোখ কপালে ওঠে।তিনি দেখেন,আধার কার্ডে তাঁর নাম ঠিকানা সব ঠিক থাকলেও তাঁকে পুরুষ (Male)বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এরজন্য শুধু তার সন্মানহানী হয় নি,তাঁকে নানা অসুবিধার মধ্যেও পড়তে হচ্ছে।
রেখাদেবীর কথায়,স্বামী মারা যাবার পর স্ত্রী হিসাবে তিনি যেহেতু পেনশন পাবার যোগ্য তাই সরকারী দপ্তরে তাঁর নিজের নথিপত্র জমা দেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।এই ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করে আধার কার্ডে তাঁকে পুরুষ বলে উল্লেখ থাকাটা। এটা সংশোধনের জন্য সম্প্রতি তিনি নবগ্রাম পোস্ট অফিসে যান।তিনি যে মহিলা সেই সংক্রান্ত সমস্ত নথিপত্র জমা দিয়ে পুণরায় যাবতীয় প্রক্রিয়া সেরে আসেন।কিন্তু এত কিছুর পরেও আধার কার্ডে তাঁর আর পুরুষ থেকে মহিলা হয়ে ওঠা হয় না ।নতুন যে আধার কার্ড তাঁর বাড়িতে এসেছে সেটিতেও একই ভাবে তাঁকে পুরুষ বলেই উল্লেখ করা হয়েছে।কি কারণে এই অভব্যতা ? কেনই বা তাঁকে এইভাবে হয়রান করা হচ্ছে, তার কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না বলে রেখাদেবী জানিয়েছেন।
আধার কার্ডে প্রবীণা রেখাদেবীকে পুরুষ বলে উল্লেখ করা হয়েছে জেনে ক্ষোভ চেপে রাখেন নি পাঁচড়া গ্রামের বাসিন্দারা। গ্রামবাসী প্রেমনাথ ঘোষাল বলেন,ভারতীয় নাগরিকের অন্যতম দুটি পরিচয় পত্র হল প্যান ও আধার কার্ড। আয়কর দফতর প্যানের সঙ্গে আধার লিঙ্ক করাটা বাধ্যতামূলক করেছে।এর জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমাও
বেধে দেওয়া হয়েছে।প্রেমনাথ ঘোষালের অভিযোগ ,এতকিছু সত্ত্বেও সঠিক আধার কার্ড পেতে এখনও দেশের প্রবীন নাগরিকদেরও হয়রান হতে হচ্ছে।প্রেমনাথ বাবুর দাবি,জনগনকে
ফ্যাসাদে ফেলতেই পরিকল্পনা মাফিক আধারে মহিলাকে পুরুষ,পুরুষকে মহিলা বলে উল্লেখ করেদওয়া হচ্ছে।এরও তদন্ত হওয়া দরকার বলে প্রেমনাথ ঘোষাল মন্তব্য করেছেন ।
চ্যাটার্জী পরিবারের ঘনিষ্ট প্রতিবেশী বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, আমি রেখাদেবীকে জেঠিমা সম্বোধন করি।প্রথমবার যখন জেঠিমা হাতে আধার কার্ড পান তখনই দেখেন আধারে তাকে মহিলার পরিবর্তে পুরুষ করে দেওয়া হয়েছে।তা জন্য জেঠিমাকে সমস্যায় পড়তে হচ্ছিল।তাই আধারের ওই ভুল সংশোধনের জন্য মাসদুই আগে তিনি প্রবীণা রেখাদেবীকে টোটোয় চাপিয়ে নিয়ে নবগ্রাম পোস্ট অফিসে যান।রেখাদেবী যে মহিলা সেই সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য প্রমান ও ৫০ টাকা সংশোধনী ফিজ পোস্ট অফিসে জমা দিয়ে সব প্রক্রিয়া সেরে আসেন । ডাক বিভাগ থেকে বলা হয় চিন্তার কিছু নেই।ভুল সংশোধন হয়ে যাবে।কিন্তু কিছুদিন আগে যখন রেখাদেবীর ঠিকানায় নতুন আধার কার্ড আসে তখন দেখাযায় সেই একই ভুল রয়েই আছে । এবারও আধারে রেখাদেবীকে পুরুষ বলেই উল্লেখ করা হয়েছে।বিশ্বজিৎ বাবুর দাবি,’যতবার মানুষজন ভুল সংশোধন করতে যাবে ততবার ফিজ আদায় হবে ।এই পরিকল্পনা নিয়েই হয়তো ইচ্ছাকৃত ভাবেই আধারে এমন ভুল তথ্য উল্লেখ করে দেওয়া হচ্ছে’।
রেখাদেবীর বড় ছেলে রবিশংকর চ্যাটার্জী বলেন,আমার মা দেশের একজন প্রবীণা নাগরিক।তা জেনেও আধার কার্ডে আমার মা কে পুরুষ বলে উল্লেখ করাটা শুধু অভব্যতাই নয়,অসন্মানেরও বটে । এমনকি এইসব করে একজন প্রবীণা নাগরিককে হয়রানও করা হচ্ছে।প্রবীণ নাগরিকদের সঙ্গে এমন অভব্যতা ও হয়রানী আইনি পথে বন্ধের বিষয়ে রবিশংকর বাবুর প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গিয়েছে।
এই বিষয়ে নবগ্রাম পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার মাধুরী টুডুর সাফাই,’এই ভুলের জন্য আমাদের তো কিছু করার নেই।এই রকম হ্যারাস অনেকেই হচ্ছেন। এ্যাকচুয়ালি পোস্টাল ডিপার্টমেন্ট এক্ষেত্রে এজেন্সি হিসাবে কাজ করে মাত্র।কেন বার বার ওই বৃদ্ধার আধার এমন ভুল হচ্ছে সেটা আধার দপ্তরই (UIDAI) বলতে পারবে ।’ আর নবগ্রাম পোস্ট অফিসে বসে উত্তম ঘোষ নামে যে ব্যক্তি আধারের কাজ করেন তাঁর সাফাই,’পুরানো এজেন্সি এইসব ভুল করে গেছে।এই ভুল সংশোধনের জন্য রেখাদেবীকে আরো একবার পোস্ট অফিসে এসে সংশোধন প্রক্রিয়া সেরে যেতে হবে ।’।