এইদিন ওয়েবডেস্ক,রংপুর,২৯ জুলাই : বাংলাদেশে হিন্দুদের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ এনে অমানবিক হামলা, আক্রমণ ও নির্যাতনের ঘটনা ক্রমবর্ধমান হারে ঘটছে। সাম্প্রতিককালে, এমন একাধিক ঘটনার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, ফেক আইডি বা ভুয়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে নিরীহ হিন্দু যুবকদের ফাঁসানোর একটি পরিকল্পিত চক্র সক্রিয় রয়েছে। সর্বশেষ রঞ্জন রায়ের(১৭) বিরুদ্ধে উত্থাপিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগ বিশ্লেষণ করেও একই চিত্র পাওয়া গেছে। ভুয়ো আইডি করে নিজেদের নবি সম্পর্কে কটুক্তি করে ওই হিন্দু কিশোরকে ফাঁসিয়েছিল কোনো এক জিহাদি । আর তার পরিনাম ভুগলো ওই কিশোরসহ ১৮ টি হিন্দু পরিবার । স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন পরিবারগুলির বাড়িতে চড়াও হয়ে সর্বস্ব লুটপাট করে ভাঙচুর চালিয়েছে ।
যেটা জানা গেছে,হতভাগ্য কিশোর রঞ্জন রায়ের “Ronjon Roy Lrm” নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে । একই নামে এবং প্রোফাইল ছবি দিয়ে আরও একটি ভুয়ো অ্যাকাউন্ট করে কোনো এক জিহাদি ইসলাম, কোরান ও হযরত মহম্মদকে নিয়ে ১৫ জুলাই থেকে ২৬ জুলাই একাধিকবার কটূক্তিমূলক পোস্ট করে । তবে পর্যবেক্ষণ ও তথ্য বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া গেছে, এই আইডিটি একটি ভুয়া আইডি, যা একজন নির্দোষ কিশোরকে প্রাণে মেরে ফেলা এবং মুসলিমদের উসকানি দিয়ে হিন্দুদের দেশ ছাড়া করার গভীর ষড়যন্ত্র৷ যা কোনো ইসলামি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলির দিকে ইঙ্গিত করে ।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, “Ronjon Roy Lrm” নামের ভুয়া অ্যাকাউন্টটিতে প্রায় ৫০০-এর বেশি বন্ধু রয়েছে। এই আইডির প্রথম পাবলিক পোস্ট দেখা যায় গত ২৩ জুন, যেখানে একটি সাদা অ্যাপ্রন ও স্টেথোস্কোপসহ প্রোফাইল ছবি আপলোড করা হয়েছিল। এই ছবিটি ঝাপসা ও নিম্নমানের। অন্যদিকে, একই নামের একটি প্রকৃত আইডি খুঁজে পাওয়া গেছে, যেখানে একই প্রোফাইল ছবিটি আরও আগেই, অর্থাৎ গত ২২ মে পোস্ট করা হয়েছিল। প্রকৃত আইডির ছবিটি পরিষ্কার ও উচ্চ রেজোলিউশনের। এটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, আসল আইডি থেকে ছবি কপি বা স্ক্রিনশট নিয়ে কেউ ভুয়া আইডিটি তৈরি করেছে।
ভুয়ো আইডিটির উদ্দেশ্যমূলক কার্যক্রমের আরও প্রমাণ পাওয়া যায় ১৫ জুলাইয়ের একটি পোস্টে। ইসলামেত নবিকে কটূক্তির আগেই ভুয়া আইডি থেকে একটি ছবি পোস্ট করা হয়, যেখানে লেখা ছিল—”আমার বউ আর আমার জান (ex-girlfriend)”। অথচ এই একই ছবি আসল আইডিতেও পাওয়া গেছে ১৫ জুলাই, কিন্তু সেখানে ক্যাপশন ছিল শুধুমাত্র—”আমার বউ”। এখানেই শেষ নয়, ভুয়া আইডির ছবিটিতে নারীর পোশাকে বিকৃতি লক্ষ্য করা গেছে এবং ছবির কর্ণারে ‘AI’ লেখা আছে, যা থেকে বোঝা যায় ছবিটিকে ডিজিটালভাবে এডিট করা হয়েছে।
এই সমস্ত তথ্য পর্যালোচনা করে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ‘Ronjon Roy Lrm’ নামের যে অ্যাকাউন্ট থেকে ধর্ম অবমাননাকর পোস্ট করা হয়েছে, সেটি একটি ভুয়া অ্যাকাউন্ট। এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে একজন নির্দোষ কিশোরকে প্রাণে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে মুসলিমদের উস্কানি দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে। মনে করা হচ্ছে, এই উস্কানিমূলক কাজ ওই ব্যক্তির রঞ্জনের কলেজের কোনো মুসলিম বন্ধুর দ্বারাই করা হয়েছে।প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রঞ্জন রায়ের বিরুদ্ধে আনা ধর্ম অবমাননার অভিযোগের পেছনে ভুয়ো আইডি ব্যবহার করে কে বা কারা এই চক্রান্ত করেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তবে, নির্দোষ রঞ্জন রায়কে গ্রেফতার করার পরেও পরিস্থিতি শান্ত হয়নি। বরং, উত্তেজিত মুসল্লিরা বিভিন্ন স্থানে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় নির্মমভাবে হামলা চালিয়েছে, ভাঙচুর করেছে বাড়িঘর ও উপাসনালয়। পাশাপাশি বুবুক্ষুর দল ব্যাপক লুটপাট চালাচ্ছে । এই ঘটনা বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে আবারও বড় প্রশ্ন তুলেছে। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এই হামলা ও ভাঙচুরের ফলে যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা কে পুষিয়ে দেবে? ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুদের এই বিশাল ক্ষতিপূরণ কে বহন করবে?
আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, যারা গুজব ছড়িয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করে উস্কানি দিয়ে এই ধরনের সাম্প্রদায়িক গন্ডগোল পাকিয়েছে, তাদের কি আদৌ বিচার করতে পারবে প্রশাসন? অতীতেও এমন অনেক ঘটনার নজির রয়েছে, যেখানে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগে হিন্দুরা বিনা দোষে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সেসময় ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হলেও পরবর্তীকালে তার কোনো সুরাহা হয়নি। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ ধরনের ঘটনায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রচলিত থাকার কারণে প্রকৃত দোষীরা পার পেয়ে যাচ্ছে এবং নির্দোষ মানুষ ও সম্প্রদায় বারবার হামলার শিকার হচ্ছে। এ পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে ফেক আইডি ব্যবহারকারীদের এবং উস্কানিদাতাদের দ্রুত শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট মহল। একই সাথে, ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রুত ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করার দাবিও উঠেছে।।