বেদ ও সনাতন সংস্কৃতিতে নারীর অবদান চিরকালই সমাদৃত। বৈদিক জীবনধারায় যেমন আমরা গৃহস্থকালে নারী-পুরুষের সম অবদানের উল্লেখ পাই একইভাবে সমাজের উন্নতিকল্পে বিদ্বান বা পণ্ডিতা নারীর বিকল্প নেই।
একজন শিক্ষিত মা-ই শিক্ষিত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সৃষ্টি করার মূল কারিগর। আজ আমরা বেদে বিদুষী নারীর বিষয়ে কি বলা হয়েছে তা সম্পর্কে জানবো –
চোদয়িত্রী সূনৃতানাং চেতন্ত্রী সুমতীনাম্।
যজ্ঞং দধে সরস্বতী ।। (যজুবেদ ২০।৮৫)
- বিদুষী নারী আমাদের মধুর, প্রেমময়, সত্য বাণী কথনের প্রেরণা দান করেন, আমাদের ভেতরকার সুনীতিকে জাগ্রত করেন। তিনি আমাদের গৃহাশ্রম-যজ্ঞ, ব্যবহার-যজ্ঞ এবং জ্ঞান-যজ্ঞকে সঞ্চালিত করেন।
মহোহঅর্ণ সরস্বতী প্র চেতয়দি কেতুনা।
ধিয়ো বিশ্বা বিরাজতি। (যজু০ ২০।৮৬) - বিদুষী নারী জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষার দ্বারা আমাদের মধ্যে জ্ঞানের প্রখর প্রবাহকে নিয়ে আসেন। তিনি আমাদের সমগ্র জ্ঞান, বিচার এবং কর্মকে প্রকাশের দ্বারা উদ্ভাসিত করেন।
যস্য স্তনঃ শশয়া ময়োভূর্যেন বিশ্বা পুষ্যসি তমিহ ধাতবে কঃ। (ঋ০ ১।১৬৪।৪৯) - হে বিদুষী! তোমার এই জ্ঞান-রূপ স্তন অত্যন্ত বিশ্রামপ্রদায়ক এবং আনন্দদায়ক, যার দ্বারা তুমি আমাদের ভেতরকার সমস্ত বরণীয় গুণকে পুষ্ট করো, যা আমাদের ভেতর রমণীয়তার সঞ্চারণ করে, যা আমাদের জ্ঞান-সম্পদ প্রাপ্ত করায়, যা আমাদের অনেক উৎকৃষ্ট ধন প্রদান করে, ঐ দিব্য স্তনকে আমাদের পান করানোর উপক্রম করো।
ত্বে বিশ্বা সরস্বতী শ্রিতাংয়ুষি দেব্যাম্। শুনহোত্রেষু মৎস্ব প্রজাং দেবি দিদিভূঢ নঃ। (ঋ০ ২।৪১।১৭)
- হে বিদুষী! তোমার মতো দেবীর উপর সকলের জীবন আশ্রিত, কারণ তুমি সকলকে যথায়োগ্য শিক্ষা প্রদান করো। যিনি বিদ্যাবৃদ্ধ, তাদের মধ্য থেকে তুমি আনন্দ লাভ করো এবং হে দেবী! যে অবিদ্বান প্রজা রয়েছে তাদের উপদেশ দিয়ে শিক্ষিত করো।
পাবীরবী কন্যা চিত্রায়ুঃ সরস্বতী বীরপত্নী ধিংয় ধাৎ।
গ্রাভিরচ্ছিদ্রং শরণং সজোষা দুরাধর্ষ গৃণতে শর্ম য়ংসৎ। (খা০ ৬।৪৯।৭)
- চরিত্রকে পবিত্রকারী, কমনীয় গুণ-কর্ম-স্বভাবযুক্ত, অদ্ভুত জীবনের অধিকারী বীর পতির পত্নি বিদুষী নারী সবাইকে উৎকৃষ্ট জ্ঞান এবং উৎকৃষ্ট কর্মের উপদেশ করুন। প্রীতিপূর্বক সেবা প্রদানকারী নিজের সুশিক্ষিত অমৃতবাণীর দ্বারা বেদপাঠকারীদের নির্দেশনা স্মরণ এবং অকাট্য সুখ প্রদান করতে থাকুন।
ইয়ং শুষ্মেভির্বিসখা ইবারুজৎসানু গিরীণাং তবিদেভিরূর্মিভিঃ।
পারবতঘ্নীমবসে সুবৃৎক্তিভিঃ সরস্বতীমা বিবাসেম ধীতিভিঃ। (ঋ০ ৬।৬১।২)
- যেভাবে নদী নিজের বলবান বৃহৎ বৃহৎ ঢেউ দ্বারা পর্বতের সুদৃঢ় উন্নত শিলাকে অনায়াসে ভেঙে ফেলে, যেভাবে কেউ পদ্মবৃন্তকে বিচ্যুত করে, ঠিক সেভাবেই বিদুষী নারী নিজের আচ্ছাদিত করা বলশালী বাণী এবং প্রজাদের সাথে বিরোধকারীদের কুতর্ককে ছিন্ন করেন। এসো, পরম বিদুষী নারীদের আমরা শুভ্র সুপ্রবৃত্ত বাণী এবং কর্মের দ্বারা পূজা করি।
সরস্বতী দেবনিদো ন বর্হয় প্রজ্ঞাং বিশ্বস্য বৃসিয়স্য মায়িনঃ৷
উত ক্ষিতিভ্যোহবনীরবিন্দো বিষমেভ্যো অস্রবো বাজিনীবতি। (ঋ০৬।৬১।৩)
- হে বিদুষী! শিক্ষা এবং সদুপযোগের দ্বারা মানুষের হৃদয় থেকে দেবনিন্দক প্রবৃত্তিকে নষ্ট করো, সমস্ত বিদ্যাচ্ছাদক মায়াবীদের উৎপাদিত অবিদ্যা রূপ প্রজাকে বিচ্ছিন্ন করো। মানবদের রক্ষক বেদবাণীকে প্রাপ্ত করাও। হে উত্তম কর্মের আচরণকারী বিদুষী! তুমি মানবদের প্রতি জ্ঞানরস ঠিক ঐভাবেই প্রবাহিত করো যেভাবে নদী জল প্রবাহিত করে।
ভদ্রমিদ্ভদ্রা কৃণবৎসরস্বত্যকবারী চেততি বাজিনীবতী।
গৃণানা জমদগ্নিবৎস্তুবানা চ বসিষ্ঠবৎ। (ঋ০৭।৯৬।৩)
ভদ্র গুণ-কর্ম-স্বভাব যুক্ত বিদুষী নারী সবার ভালোই করেন, অকুৎসিত আচরণ যুক্ত জ্ঞান-কর্ম-পরায়ণ সেই বিদুষী সবাইকে জ্ঞানবান এবং জাগ্রত করেন। মন্ত্র উচ্চারণকারী প্রজ্জ্বলিতাগ্নি অগ্নিহোত্রের সমতুল্য সদুপদেশ প্রদান করেন এবং অতিশয় জ্ঞানধন সম্পন্ন বিদ্বানের মতো প্রত্যেক পদার্থের গুণ-ধর্মকে ব্যাখ্যা করেন।
সরস্বতীং দেবয়ন্তো হবন্তে সরস্বতীমধ্বরে তায়মানে।
সরস্বতীং সুকৃতো অহবয়ন্ত সরস্বতী দাশুষে বাৰ্যং দাৎ। (ঋ০ ১০।১৭।৭)
- যে লোক সমাজকে দেব করার ইচ্ছুক হন, তিনি বিদুষী নারীকে আদরপূর্বক নিমন্ত্রণ করেন। যখন যজ্ঞানুষ্ঠান হুমকির মুখে পড়ে, ঠিক তখনই বিদুষী নারীকে আহবান করা হয়। পুণ্যকর্মে তৎপর মানবও পুণ্য কর্মের ধারাকে প্রবৃত্ত রাখার জন্য বিদুষী নারীকে আহ্বান করেন। বিদুষী নারীকে যিনি সম্মান করেন, তাকে বিদুষী নারী বরণীয় ঐশ্বর্য, উপদেশ সুখ আদি প্রদান করেন।
গৌরীর্মিমায় সলিলানি তক্ষত্যেকপদী দ্বিপদী সা চতুষ্পদী।
অষ্টাপদী নবপদী বন্ধুবুষী সহস্রাক্ষরা পরমে ব্যোমন। (ঋ০ ১।১৬৪।৪১)
- বিদ্যা জ্যোতি দ্বারা উজ্জ্বল বিদুষী নারী জ্ঞান ধারাকে বহমান করে সদুপদেশ প্রদান করেন। তিনি ওঙ্কার রূপ একপদের ধ্যান-চিন্তন করেন। উনি অভ্যুদয় এবং নিঃশ্রেয়স্বরূপ দুই পদকে জীবনে চরিতার্থ করেন। উনি চার বেদরূপ চার পদের অধ্যায়ন-অধ্যাপনা করেন এবং ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষরূপ চার পদের প্রাপ্তি করানোয় যত্নশীল থাকেন। উনি চার বর্ণ এবং চার আশ্রমরূপ আট পদকে সমাজে প্রচার করেন। তিনি পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং-অন্তঃকরণ চতুষ্টয় এই নয় তত্ত্বকে আত্মায় কেন্দ্রীভূত করার অভ্যাস করেন এবং করান। উনি সহস্র অক্ষরের উচ্চারণ করে উচ্চ রাষ্ট্রে নিজের বাণীকে প্রসারিত করেন।
যদাশসা বদতো মে বিচুক্ষুভে যদ্যাচমানস্য চরতো জনামনু।
যদাত্মনি তম্বো মে বিরিষ্টং সরস্বতী তদা পূণদঘৃতেন। (অথর্ব০ ৭।৫৭।১)
- যখন আমি যখন কারো সাথে কথা বলি তখন অনেক সময়ই অনেকবার আমার মন কোন আঘাতের কারণে বিক্ষুব্ধ হয়। যখন আমি কোন সৎকার্য সিদ্ধির জন্য মানবের কাছে ধন কামনা করি, তখনও অনেকসময় দানে অনিচ্ছুক ব্যক্তিদের টীকাটিপ্পনীর জন্য আমার মনে ক্ষোভ আসে। এইভাবেই অনেকবার অনেকের ব্যবহারের দ্বারা আমার শরীর বা আত্মায় আঘাত লেগেছে । বিদুষী নারী নিজের সম্ভাবনা এবং সদুপদেশরূপ ঘৃত (ঔষধী) দ্বারা সেই ক্ষোভ এবং আঘাতের দ্বারা উৎপন্ন আমার ক্ষতকে ঠিক করে দিন।
তাই পরিবেশেষে জগদীশ্বরের নিকট আমাদের প্রার্থনা ও সনাতন সমাজের প্রতি আহবান – হে প্রভু! আমাদের রাষ্ট্রে বিদুষী নারী উৎপন্ন হউক এবং আমরা তার সম্মান করা শিখি, যার মাধ্যমে আমাদের রাষ্ট্র গৌরবের শিখরে উন্নীত হতে পারে ।।