এইদিন ওয়েবডেস্ক,তেহেরান,১৩ মে : বড়লোকের ১৪ বছর বয়সী কিশোরী মেয়ের উপর দীর্ঘ দিনের লোভ ছিল ৪ সন্তানের জনক মধ্য বয়সী আলির । কিন্তু কামোন্মাদ আলির বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার স্ত্রী সুরাইয়া,দুই কন্যা আর দুই পুত্র সন্তান । তাই পথের কাঁটা সুরাইয়াকে চিরতরে সরাতে ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা করে ফেলে আলি । হাতিয়ার করে নিজের ইসলাম ধর্মকে । গ্রামের মূল মৌলবীর অতীত কেচ্ছা ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দেখিয়ে ব্লাকমেল করে রটিয়ে দেয় তার স্ত্রী পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে আছে । ভয় দেখিয়ে কয়েকজন সাক্ষীও জুটিয়ে ফেলে আলি । বসে বিচারসভা । সুরাইয়ার স্বামী ও সাজানো স্বাক্ষীদের বয়ান শুনে বধূকে পাথর ছুড়ে মারার নির্দেশ দেয় বিচারসভায় উপস্থিত মৌলবী ও কট্টরপন্থী জনতা ।
মৃত্যুদণ্ডটাও ছিল ভয়ানক । প্রকাশ্যে রাস্তায় গর্ত খোঁড়া হয়। সুরাইয়ার হাত পা বাঁধা হয়। গর্তে কোমর পর্যন্ত পোঁতা হয় সুরাইয়াকে । কোমড় থেকে নিচে পর্যন্ত মাটি দিয়ে শক্ত করে ভরাট করা হয় চারপাশ। তারপর গ্রামের লোকজন দূর থেকে পাথর ছুড়ে অমানবিক যন্ত্রণা দিয়ে মেরে ফেলে ওই বধূকে । বধূর স্বামী ও বিচারসভায় উপস্থিত মৌলবীরা এতটাই হৃদয়হীন ছিল যে সুরাইয়ার বাবাকে দিয়েই তারা প্রথম পাথর ছোড়া করায় । যদিও তার ছোড়া একটা পাথরও মেয়ের কাছ পর্যন্ত পৌঁছয়নি । এমনকি বধূর দুই পুত্রকেও তাদের মায়ের উদ্দেশ্যে পাথর ছুড়তে বাধ্য করা হয় । এটা কোনো কল্পিত ঘটনা নয়,বরঞ্চ বাস্তব ঘটনা । আর এই ঘটনাটি ঘটেছিল কট্টর মৌলবাদী রাষ্ট্র ইরানের একটা ছোট্ট গ্রামে ।
ঘটনাটি এতদিন ধামাচাপা দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত ইরানের মানুষই বিষয়টি প্রকাশ্যে নিয়ে আসে । আর সেই অমানবিক বাস্তব ঘটনাটি “দ্য স্টোনিং অফ সুরাইয়া এম” সিনেমার মধ্য দিয়ে মানুষের সামনে নিয়ে আসেন চিত্র পরিচালক সাইরাস নওরাস্তেহ (Cyrus Nowrasteh) । তিনি তার ছবিতে দেখিয়েছেন,একজন সাংবাদিক ইরানের ওই গ্রামের মধ্য দিয়ে যখন যাচ্ছিলেন তখন তার গাড়ি খারাপ হয়ে যায় । জারা নামে স্থানীয় এক মহিলা তাকে তার বাড়িতে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায় । আর সাংবাদিক তার বাড়িতে যাওয়ার পর ওই মহিলা সুরাইয়াকে পাথর ছুড়ে মারার ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা করেন । জারার কথামত সমস্ত বয়ান রেকর্ড করে রাখেন ওই সাংবাদিক । জারা আসলে সুরাইয়ার কাকিমা । তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেও আলির ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের হাত থেকে সুরাইয়াকে বাঁচাতে পারেননি ।
সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার বিবরণে সাংবাদিককে ওই মহিলা জানান,বেশ কিছুক্ষণ ধরে পাথর ছোঁড়ার পর সুরাইয়া নিস্তেজ হয়ে পড়েন ৷ তার মুখ ও মাথা দিয়ে গড়িয়ে পরা রক্তে ভিজে যায় আসপাশের মাটি । তখন সুরাইয়ার স্বামী আলি তার কাছে যায় । উবুড় হয়ে পড়ে থাকা সুরাইয়ার রক্তাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে পরীক্ষা করে, সে বেঁচে আছে কিনা । কিন্তু তখনো বেঁচে ছিলেন সুরাইয়া । তিনি চোখ খুলে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে যেন বলতে চেয়েছিলেন,’কেন এমন করলে আমার সাথে ?’ কিন্তু ১৪ বছরের কিশোরীর প্রেমে উন্মাদ আলি তার স্ত্রীর চোখের ভাষা বুঝেও না বোঝার ভান করে । তারপর সে স্ত্রীর কাছ থেকে ফিরে এসে তার জীবিত থাকার খবর মৌলবীর কানে তুলে দেয় । ফের শুরু হয় সুরাইয়াকে লক্ষ্য করে পাথর ছোড়া । অবশেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ওই অসহায় বধূ ।
পরিচালক সাইরাস নওরাস্তেহ এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি চলচিত্রে রূপ দেওয়ার আগে ইরানি লেখক ফ্রিদৌনি সাহেবজাম ১৯৯০ সালে বইয়ের আকারে প্রকাশ করেছিলেন । কিন্তু বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেয় ইরানের মৌলবাদী সরকার । যদিও বইটি ইন্টারন্যাশনাল বেস্টসেলার হয় । পরে ২০০৮ সালে ওই কাহিনী রূপালি পর্দায় নিয়ে আসেন সাইরাস নওরাস্তেহ । একজন ইরানি বধূর ওই ভয়ঙ্কর পরিণতির ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত সিনেমা দেখে এখনো শিহরিত হন দর্শকরা ।।

