জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,মঙ্গলকোট(পূর্ব বর্ধমান),০২ মার্চ : পূব আকাশে লাল আভা দেখতে পাওয়া তো দূরের কথা, তখনও ভোরের পাখিদের কলতান শোনা যায়নি। ডেকে ওঠেনি পাড়ার মুরগিগুলো। রাত শেষ হওয়ার মুখে কোনো এক রাতের পাখি তখন শেষবারের মত ডাক দিয়ে ফিরে যায় নিজের বাসায়। গৃহস্থ মানুষ হয়তো কোনো মিষ্টি স্বপ্ন দেখতে দেখতে পাশ ফিরে শুয়েছে। একরাশ স্বপ্ন বুকে নিয়ে ওরা তখন প্র্যাকটিস করার জন্য একে একে হাজির হচ্ছে খেলার মাঠে। ‘মর্ণিং ওয়াক’ করতে আসা মানুষরা অবাক হয়ে দেখছে একদল কিশোরী মাঠে ফুটবল নিয়ে অনুশীলনে মত্ত হয়ে রয়েছে। বাধ্য শিক্ষার্থীর মত কোচ প্রেমানন্দ মুখার্জ্জীর নির্দেশ মেনে চলেছে। গত দু’তিন মাস ধরে এই দৃশ্যটাই চোখে পড়ে পূর্ব বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোটের গণপুর ফুটবল ময়দানে।
‘বড় হতে চাই মাগো বড় হতে চাই / সুযোগ পেলে দেশের হয়ে ফুটবল মাঠ কাঁপাতে চাই’ – এই স্বপ্ন ওদের বক্ষ জুড়ে। ওরা পশ্চিম মঙ্গলকোটের গণপুর গ্রামের কল্যাণী, পূজা, পূর্ণিমা, মেনকা, শিউলি, লতিকা, রূপালী, মানসী, অঞ্জলি, বর্ষা (ছোট), দেবীকা, বর্ষা (বড়) সহ প্রায় জনা তিরিশ আদিবাসী কিশোরী। ওরা সব গণপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী। কেউ কেউ আগামী বছর মাধ্যমিক পরীক্ষাও দেবে। অভাবের সংসারের জন্য মাঝে মাঝে বাড়ির অভিভাবকদের সঙ্গে ওরা মাঠে কাজ করতে যায়। যেমন এখন মাঠ থেকে আলু তোলা হচ্ছে। তাই অনেকেই এখন সকালের দিকে খেলার মাঠে ঠিকমত প্র্যাকটিস করতে আসতে পারছেনা। তাই বলে স্বপ্ন ওদের মরে যায়নি।
স্বপ্ন দেখাটা শুরু হয়েছিল বছর দুয়েক আগে যখন তাদের প্রিয় মাঠে একদল কিশোরী ফুটবলার একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ফুটবল খেলায় অংশগ্রহণ করে। তাছাড়া টিভিতে মহিলা ফুটবল দলের খেলা দেখতে দেখতে ওরাও বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। স্বাভাবিক ছটফটানি তো ওদের আছেই।
কিন্তু শুধু স্বপ্ন দেখলেই তো হবেনা, স্বপ্ন পূরণ করতে হলে খেলার সরঞ্জাম দরকার। গরীব ঘরের মেয়ে ওরা। কোথায় পাবে ফুটবল, বুট, জার্সি সহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক দরকারি সামগ্রী? দুশ্চিন্তার কালো মেঘ যখন ওদের স্বপ্নকে ঘিরে ধরেছে ঠিক তখনই ওরা শুনতে পায় একদল ছেলে এবং সঙ্গে দু’একজন কিশোরী ফুটবল প্র্যাকটিস করছে। ভয়ে ভয়ে দ্যাখা করে কোচের সঙ্গে। সেই ওদের পথচলা শুরু। নিজেদের পক্ষে যতটা সম্ভব ওরা খেলার সামগ্রী মানে জার্সি ও বুট জোগাড় করে। বাকিটা ওদের কোচ বিভিন্ন জায়গা থেকে জোগাড় করে দেয়। এগুলো নিয়েও গভীর অনুশীলনে মেতে ওঠে ওরা।এসব ঘটনা মাস তিনেক আগের। তারপর থেকে নিত্য ওরা ফুটবল অনুশীলনীতে মত্ত হয়। সঙ্গে আছে পড়াশোনা ও বাড়ির কাজ। ফুটবল খেলার জন্য যতটা পুষ্টিকর খাবারের দরকার সেটাও জোটেনা। এতকিছু অভাবের মধ্যেও স্বপ্ন পূরণের নেশায় ওরা মশগুল।
প্র্যাকটিস করতে করতে মেনকা বলল, আমরা স্যারের নির্দেশ মত অনুশীলন করে চলেছি। আমাদের লক্ষ্য দেশের হয়ে ফুটবল খেলা। জানি এরজন্য আমাদের অনেক পরিশ্রম করতে হবে। আমরা হাল ছাড়তে রাজি নই। স্যার আমাদের জন্য অনেক করছেন। এখন সহৃদয় ব্যক্তি বা সরকার যদি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় তাহলে আমরা আরও কিছু খেলার সামগ্রী কিনতে পারব। কেউ কি ওদের আবেদন শুনতে পাচ্ছেন?
অন্যদিকে ওদের কোচ প্রেমানন্দবাবু বললেন, নিজেকে ফিট রাখার জন্য আমি নিয়মিত মাঠে আসি। বেশ কিছু ছেলে আমার কাছে কোচিং নিতে আসে। মাঝে মাঝে দু’একজন কিশোরী এসেছে এবং চলেও গ্যাছে। কিন্তু এদের ডেডিকেশন বা খেলার আগ্রহ অন্যরকম। চেষ্টা করছি ওদের কিছু শেখাতে। দেখি শেষপর্যন্ত কি হয়?
প্রসঙ্গত,একটা সময় পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতার প্রেমানন্দবাবু নিজে দুর্দান্ত ফুটবল খেলেছেন। বর্ধমানের ফুটবল লিগে তিনি ছিলেন নিয়মিত। স্বাভাবিক ভাবেই খেলার মাঠে পরিচিতি প্রচুর। সেই পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে খেলা পাগল এইসব গরীব ঘরের কিশোরীদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করে চলেছেন। তবে তারমতে দরকার একটু সরকারি সাহায্য ।।