এইদিন ওয়েবডেস্ক,ঢাকা,১১ জুন : ফেসবুকের পুরনো একটি পোস্টের মন্তব্যের ঘরে নবীকে কটূক্তির অভিযোগ আবার সামনে আসার পর ‘হুমকির মুখে’ পড়তে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া বাংলাদেশের মানিকগঞ্জের সিংগাই উপজেলার জামশা ইউনিয়নের দক্ষিণ জামসা গ্রামের বাসিন্দা শাকিল আহমেদ (২৪)কে৷ তারপর থেকে তিনি সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কায় চরম আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন । শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শেষ বর্ষের ছাত্র শাকিল আহমেদ আত্মঘাতী হয়েছেন । সোমবার মধ্যরাতে নিজের বাড়িতে তিনি গলায় ফাঁস দিয়ে ‘আত্মহত্যা’ করেন বলে জানান সিংগাইর থানার ওসি জে ও এম তৌফিক আজম।
পুলিশ জানায়, সাত-আট মাস আগে শাকিল একজনের পোস্টে একটি মন্তব্য করেছিলেন। ওই মন্তব্যে নবীকে নিয়ে ‘কটূক্তি’ করা হয় বলে তখন অভিযোগ উঠেছিল। পরে তিনি সেই মন্তব্য মুছে ফেলেন এবং আরেকটি পোস্ট করে ক্ষমা চান। পুরনো সেই পোস্ট সোমবার আবার ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে শাকিলকে এবং তার বাড়িতে গিয়েও কিছু লোক হুমকি দেয় বলে পরিবারের সদস্যদের তরফে অভিযোগ করা হয়।ওসি তৌফিক আজম বলেন, ‘ছাত্রটি ফেসবুকে আত্মহত্যার একটি নোট পোস্ট করে নিজের ভুল স্বীকার করে মধ্যরাতে আত্মহত্যা করেন।’ তার লাশ উদ্ধার করে মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা হয়েছে বলে তিনি জানান ।
শাকিলের ফেসবুক আইডির নাম ‘শাকিল চিত্রকর’। সোমবার রাতে সেই আইডি থেকে পরপর কয়েকটি পোস্ট দিয়েছিলেন তিনি। সবশেষ একটি পোস্টে তিনি লেখেন,’আমি নাস্তিক নই, গ্রামের সবাই আমাকে নাস্তিক বলছে। আমি জানি আর আমার আল্লাহ জানে, আমি নবী মুহাম্মদকে কোনো কটূক্তি করিনি। আমাকে নিয়ে আমার বাবা অনেক গর্ব করত, গ্রামের সবাই আমাকে অনেক সম্মান করত। আজ আমি আমার নিজের আপন মানুষের কাছে আমার সম্মান হারিয়েছি। আগামীকাল আমার বাবাকে সবাই গালি দিবে, আমার মাকে সবাই অসম্মান করবে, এই লজ্জা আমি কখনো সহ্য করতে পারব না। একটা ছেলে হয়ে নিজের বাবা–মায়ের মানসম্মান আমি এভাবে নষ্ট করে দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে পারব না। কোনো দিন আমি গ্রামে মাথা তুলে চলতে পারব না। আত্মহত্যা মহাপাপ আমি জানি। আমি অনেক পাপ করেছি, আজ আর একটা শেষ পাপের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি।’
এই বিষয়ে জামসা ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আমজাদ হোসেন বলেন,’আমার ওয়ার্ডের নুসনের ছেলে আত্মহত্যা করেছে বলে শুনেছি। তবে কেন আত্মহত্যা করেছে আমি জানি না। আর কী ঘটনা ঘটেছে জানি না, আমি জমিতে কাজে ব্যস্ত।’ তবে ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ফেসবুকে নবীকে নিয়ে কয়েক মাস আগের একটি পোস্ট সম্প্রতি সামনে এলে এলাকার গণ্যমান্যরা তার বাড়িতে গিয়ে বিষয়টা বললে সমাধান হয়ে যায় বলে শুনেছি। পরে লজ্জায় সে আত্মহত্যা করেছে।’ এই বিষয়ে শাকিলের পিসতুতো বোন মুক্তা বলেন, ‘গতকাল (সোমবার) রাতে ফেইসবুকের পোস্টের মন্তব্য নিয়ে জামশাসহ আশপাশের কয়েকশ লোক এসে শাকিলের বাড়িতে হুমকি দেয়। পরে রাতে তিনি আত্মহত্যা করেন।’
শাকিলের সহপাঠী তুশি আক্তার বলেন,’শাকিল চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের ১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন,’গতকাল রাতে তিনি পোস্ট করার পরে আমরা অনেক চেষ্টা করেছি যোগাযোগ করতে। কিন্তু তার ফোন বন্ধ হওয়ায় যোগাযোগ করতে পারেনি। পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে জানতে পারলাম তিনি আত্মহত্যা করেছেন। এখন আমরা সবাই ছুটিতে। তাই একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। আমরা এখন পর্যন্ত আসলে কী ঘটনা সেটা জানতে পারিনি।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমদ বলেন,’বিষয়টা আমি শুনেছি। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, সে বছর দুয়েক আগে পাস করে বের হয়ে গেছে। তারপরও বিষয়টা নিয়ে আমি আমার সহকর্মীদের খোঁজখবর নিতে বলেছি।’
শাকিল তার পোস্টে নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ‘দান করে’ যাওয়ার কথাও বলেছেন। সবশেষ পোস্টের আগে তিনি এই সম্পর্কিত তিনটি পোস্ট করেছেন, যেখানে তিনি ৭-৮ মাসের ওই মন্তব্য নিয়ে ‘ব্যাখ্যা’ দিয়েছেন। প্রথম একটি পোস্টে সেই মন্তব্যে ‘মাহমুদুল’ লিখতে গিয়ে ‘ভুলবশত’ ‘মুহাম্মদ’ টাইপ করেছেন, যা নিয়ে তার বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা অভিযোগ’ আনা হয়েছে বলে লেখেন। সেখানে শাকিলকে ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে তার ‘বিচার চেয়ে’ ও জামশা বাজারের মাঠে ‘উলঙ্গ করে পাথর মারার আহ্বান’ জানিয়ে শিহাব হোসাইন আবির নামের একজনের পোস্টের ‘স্ক্রিনশট’ শেয়ার করা হয়েছে। এরপর এক পোস্টে শাকিল ‘ভুলকে কেন্দ্র করে অনেক বড় বোঝাবুঝি’ হচ্ছে লেখেন এবং কিছুক্ষণ পর আর এক পোস্টে তিনি ‘ভুলের জন্য তওবা’ করে সবার কাছে ‘শেষবারের মতো ক্ষমা’ চেয়েছেন। এরপর শেষ পোস্ট দিয়ে আত্মহত্যার কথা লেখেন। শাকিল ফেসবুক পোস্টে ‘নাস্তিক অভিযোগে হেনস্তার শিকার’ হওয়ার যে কথা লিখেছেন, সেই বিষয়ে ওসি তৌফিক আজম বলেন,’বিষয়টা আমরা খতিয়ে দেখছি।’ যাদের বিরুদ্ধে হেনস্তার অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে ওসি বলেন,’পরিবার বা কারও পক্ষ থেকে অভিযোগ পেলে মামলা নেওয়া হবে। সেই অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’।

