এইদিন ওয়েবডেস্ক,কলকাতা,১২ ডিসেম্বর : পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরের আদলে রাজ্যের সমুদ্র উপকূলবর্তী শহর দীঘায় জগন্নাথ মন্দির নির্মাণের কথা ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি । ইতিমধ্যে মন্দিরের কাজ অনেকটাই এগিয়ে গেছে । বুধবার দীঘায় মন্দির পরিদর্শনে গিয়ে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন মন্দিরের উদ্বোধন করার কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী । এদিকে দীঘার কথিত জগন্নাথ মন্দির নিয়ে বিতর্ক উসকে দিয়েছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী । তার কথায়, মুখ্যমন্ত্রী পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের আদলে দিঘাতে একটা ‘ভাস্কর্য’ নির্মাণ করাচ্ছেন মাত্র । ”সরকারি টাকায় নির্মিত ওই ভাস্কর্য কখনো মন্দির হতে পারে না, আসলে ওটা একটা কালচারাল সেন্টার’ । বুধবার সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি এ নিয়ে বেশ কিছু তথ্য প্রমাণ পেশ করেন এবং বলেন যে রাজ্যে হিন্দুরা একজোট হচ্ছে৷ এটা দেখে আতঙ্কিত মমতা ব্যানার্জি । তাই দীঘাতে জগন্নাথদেব কালচারাল সেন্টার তৈরি করে তিনি আদপে হিন্দুদের সন্তুষ্ট করতে চাইছেন ।
মমতা ব্যানার্জি বুধবার দীঘায় নির্মীয়মান মন্দিরে পরিদর্শনের মুহুর্তের বেশ কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেছেন । তিনি লিখেছেন, ‘মা-মাটি-মানুষের সরকারের বিশেষ প্রচেষ্টায় পুরীর শ্রী শ্রী জগন্নাথ মন্দিরের আদলে তৈরি হচ্ছে দিঘায় জগন্নাথ মন্দির। ২০ একর জমির উপর তৈরি এই মন্দির নির্মাণ করতে ইতিমধ্যেই প্রায় ২৫০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। নির্মীয়মাণ মন্দিরের কাজের অগ্রগতি খতিয়ে দেখতে আজ আমি সশরীরে উপস্থিত ছিলাম এখানে। আগামী বছর অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্যলগ্নে এই মন্দিরের শুভ উদ্বোধন হবে। সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে মন্দির সংলগ্ন অঞ্চলে প্রশাসনিক বিল্ডিং তৈরি হবে, যেখানে পুলিশি থেকে স্বাস্থ্য – সকল ব্যবস্থাই সাধারণ মানুষের জন্য নিবেদিত থাকবে। এই মহৎ উদ্দেশ্যসাধনে আমাদের সরকার, প্রশাসন-সহ মন্দিরের নির্মাণ কার্যে জড়িত সকল শ্রমিককে আমি কুর্নিশ জানাই। সকলের মঙ্গল হোক – শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের রাতুল চরণে এই প্রার্থনা আমার।’
এদিকে শুভেন্দু অধিকারী আজ বৃহস্পতিবার পাল্টা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল হাউজিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভলাপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড’ এর টেন্ডার নোটিশের প্রতিলিপি পোস্ট করেছেন । যেখানে পরিষ্কার লেখা আছে,”জগন্নাথ ধাম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র” । এছাড়া হিডকো নামে একটা সংস্থার ওয়ার্ক অর্ডারও পোস্ট করেছেন তিনি৷ যেখানেও বলা হয়েছে, “জগন্নাথ ধাম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র” ।
প্রতিক্রিয়ায় শুভেন্দু অধিকারী লিখেছেন, জয় জগন্নাথ । আপনি দাবি করছেন যে আপনার সরকারের বিশেষ প্রচেষ্টায় পুরীর শ্রীশ্রী জগন্নাথ মন্দিরের আদলে দিঘায় তৈরি হচ্ছে জগন্নাথ মন্দির এবং এই মন্দির নির্মাণ করতে ইতিমধ্যেই প্রায় ২৫০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।কিন্তু আপনার দাবি ও বাস্তবের সাথে বিস্তর ফারাক আছে। ওয়েস্ট বেঙ্গল হাউজিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (WBHIDCO) এর টেন্ডার ও ওয়ার্ক অর্ডারের নথিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে টেন্ডার আহ্বান করার সময় কাজটি “জগন্নাথ ধাম সংস্কৃতি কেন্দ্র” হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই নথি যা আমি আবার জন সমক্ষে তুলে ধরলাম, প্রমাণ করে যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার মন্দির নির্মাণ নয়, বরং একটি “সাংস্কৃতিক কেন্দ্র” তৈরি করছে, কারণ ভারতের সংবিধান কেন্দ্রীয় হোক অথবা রাজ্য হোক, যেকোনো সরকার ও তাদের অধীনস্থ সংস্থাকে বাধা দেয়; ধর্মীয়স্থল নির্মাণে করদাতাদের অর্থ ব্যয় করতে।কেউ যদি মনে করেন যে অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের খরচ কেন্দ্রীয় সরকার বা উত্তর প্রদেশ সরকার বহন করেছে, তাহলে তারা ভুল ভাবছেন। শ্রী রাম জন্মভূমি তীর্থ ক্ষেত্র ট্রাস্ট বিশ্বজুড়ে হিন্দুদের থেকে অনুদান দিয়ে রাম মন্দির নির্মাণ করেছেন, সরকারি অর্থে নয়।
তিনি আরও লিখেছেন,’দ্বিতীয়ত, মাননীয়া আপনি যদি মনে করেন যে পুরীর শ্রীশ্রী জগন্নাথ মন্দিরের আদলে মন্দির নির্মাণ করে দিঘায় তীর্থক্ষেত্র স্থাপন করে ফেললেন, তাহলে আপনাকে বলি উৎকলের শ্রীক্ষেত্র; পুরীর জগন্নাথ ধাম সনাতন ধর্মের অন্যতম পীঠস্থান। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জগন্নাথ অবতারে পুরীর মন্দিরে অধিষ্ঠান করেন, সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের বড় ভাই বলভদ্র এবং ছোট বোন সুভদ্রাও একই আসনে অধিষ্ঠান করেন। কয়েক শতাব্দী পূর্বে নির্মিত অলৌকিক এই মন্দিরের সঙ্গে কত আশ্চর্যজনক ঘটনা জড়িত তার ব্যাখ্যা বিজ্ঞান ও দিতে ব্যর্থ। যেমন মন্দিরের চূড়ায় যে ধ্বজা লাগানো থাকে, সবসময় যে দিকে হাওয়া চলে তার বিপরীত দিকে ধ্বজাটি ওড়ে। জগন্নাথ দেবের মন্দির প্রায় ৪ লক্ষ বর্গফুট এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এবং ২১৪ ফুট উঁচু, অথচ এই মন্দিরের চূড়ার কোনও ছায়া দেখা যায় না। মন্দিরের চূড়ায় একটি চক্র লাগানো রয়েছে, যে কোনও প্রান্ত থেকে ওই চক্রের দিকে তাকান, মনে হবে চক্রটি আপনার দিকেই ঘোরানো। চক্রটির ওজন প্রায় এক টন। ১২ শতকে মন্দির নির্মাণের সময় চূড়ায় কিভাবে বসানো হয়েছিল, তা এক রহস্য, কারণ সেই সময় প্রযুক্তি কতটা উন্নত ছিল তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।’
শুভেন্দুর কথায়, ‘জনশ্রুতি, লোকগাথা, পৌরাণিক কাহিনী ও ইতিহাসের আবরণে মোড়া ভারতবর্ষের সংস্কৃতি, আত্মাধিক ও ধর্মীয় চেতনার সাথে সমার্থক সনাতনী পীঠস্থান যেমন কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, তিরুপতি শ্রী বালাজী, কামাখ্যা, কাশী বিশ্বনাথ, দ্বারকাধীশ, কৈলাস, পদ্মনাভস্বামী, বৈষ্ণো দেবী, সিদ্ধি বিনায়ক, তুঙ্গনাথ, ত্রিপুরেশ্বরী, অমরনাথ, মহাকালেশ্বর, পুরীর জগন্নাথ ধাম… এর মতো প্রাচীন ধর্মীয় তীর্থক্ষেত্রের অনুকরণ হয়তো করা যায় কিন্তু তার বিকল্প তৈরি করা যায় না। কোনো মানুষের ক্ষমতাই নেই পীঠস্থান তৈরী করার।’
সবশেষে তিনি বলেছেন,’আপনি যদি মনে করে থাকেন যে আপনার প্রচেষ্টায় পুরীর জগন্নাথ ধামের মাহাত্ম্য সামান্য হলেও কমবে অথবা আপনি বিকল্প তীর্থক্ষেত্র স্থাপন করে ফেললেন, তাহলে মহাপ্রভু জগন্নাথ দেব আপনাকে সুবুদ্ধি প্রদান করুন এই প্রার্থনা করি। জয় জগন্নাথ ।’
প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গের ভোট ব্যাংকের রাজনীতিতে ৩০ শতাংশ বা তার অধিক মুসলিম ভোট সর্বদা একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায় । মুসলিম ভোট ব্যাংক যার দিকে ঢলবে সেই রাজ্যে ক্ষমতা আসবে,এটা মোটামুটি এক প্রকার নিশ্চিত । কারণ হিন্দু ভোট ব্যাংক দ্বিধা বিভক্ত । হিন্দু ভোট ব্যাংকের ভরসাতেই মূলত এরাজ্যে সিপিএমের অস্তিত্ব টিকে আছে বলা হয় । আর এদিকে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক হলো মূলত হিন্দু । সুতরাং রাজ্যে ক্ষমতায় আসতে গেলে প্রায় ৭০% হিন্দু ভোট ব্যাংকে তাদের নিজের পালে টানতে হবে । কারণ মুসলিম ভোট বিজেপির পক্ষে ইভিএমে পড়বে না এটা নিশ্চিত ! বিগত লোকসভা নির্বাচনে হিন্দু ভোটব্যাংকের ভরসাতেই ১২ টা আসন জিততে সক্ষম হয়েছে বিজেপি । ২০২৬ এর বিধানসভা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেতে গেলে হিন্দু ভোট ব্যাংকে আরো নিজেদের পালে টানতে হবে গেরুয়া শিবিরকে । অন্যদিকে হিন্দু ভোট ব্যাংকের ধ্বস শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জির কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছে । তাই হিন্দু ভোট ব্যাংকে খুশি করতে এখন তিনি মন্দির নির্মাণের দিকে ঝুঁকছেন এবং বাংলাদেশের হিন্দু নির্যাতন নিয়ে মাঝেমধ্যে সরব হচ্ছেন বলে দাবি বিজেপির । কিন্তু মমতা ব্যানার্জির এই প্রকার রাজনৈতিক কৌশল কতটা তার পক্ষে যাবে সেটাই দেখার বিষয় । হিন্দু এবং মুসলিম ভোট ব্যাংকের সন্তুষ্ট করতে কতটা তিনি ব্যালেন্স করে চলতে পারেন সেটা আগামী বিধানসভার ভোটের ফলাফলের পরই স্পষ্ট হবে ।।