শ্যামসুন্দর ঘোষ,মন্তেশ্বর,১১ অক্টোবর : দেবীর দুই পাশে নেই লক্ষী-সরস্বতী । নেই মহিষাসুর । নেই সিংহ । পদ্মাসনা দেবীর দু’পাশে রয়েছেন জয়া-বিজয়া । ঠিক তার নিচেই কার্তিক-গনেশ । দ্বিভূজা দেবীর বাম হাত বরাভয় মূদ্রায় । ডান হাত দিয়ে দান করছেন ধন সম্পদ । পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর ব্লকের মামুদপুর-২ অঞ্চলের কাইগ্রামের দেবী অভয়া মহিষাসুরমর্দিনী নয়, বরাভয়দায়িনী রূপে আড়াই শতাধিক বছর ধরে পূজিতা হয়ে আসছেন । দেবী অভয়ার পূজো পারিবারিক ভাবে শুরু করা হলেও শতাধিকবর্ষ ধরে সার্বজনীন রূপ পেয়েছে এই পূজো । সোমবার ষষ্ঠীর দিন সকাল থেকেই নতুন পোশাক পরে অভয়ার মন্দিরে ভিড় জমাতে দেখা গেল গ্রামবাসীদের ।
জানা যায়, প্রায় ২৫২ বছর পূর্বে কাইগ্রামের মাসডাঙ্গা পাড়ার বাসিন্দা হরিপদ দত্ত নামে জনৈক এক সম্পন্ন ব্যাবসায়ী দেবী অভয়ার পূজোর সূচনা করেছিলেন । কলকাতায় হরিপদবাবুর আলকাতরা (coal tar) তৈরির কারখানা ছিল । এখনও দেশ জুড়ে খ্যাতি আছে ওই ব্রান্ডের আলকাতরার । হরিপদ বাবুর নামে কলকাতার রাসবিহারী বিধানসভা এলাকায় ‘হরিপদ দত্ত লেন’ নামকরনও করা হয়েছে ।
কাইগ্রামে হরিপদ দত্ত প্রতিষ্ঠিত দেবী অভয়ার পূজোর সূচনার পিছনে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে । গ্রামবাসীরা জানান,শোনা যায় প্রথম দিকে হরিপদ দত্তর আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না । একদিন তিনি দেবীর স্বপ্নাদেশ পান । দেবীর নির্দেশ অনুযায়ী স্থানীয় খড়ি নদীতে ভেসে আসা একটি কাঠের পাটাতনের উপর দেবী নির্দেশিত মূর্তি নির্মান করে পূজো শুরু করেন । তারপর থেকেই দেবীর আশীর্বাদে আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি হতে থাকে হরিপদবাবুর । দেবী অভয়ার সেবাইত বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘পূর্ব পুরুষদের মুখে শুনে এসেছি হরিপদবাবু ব্যাবসায় যথেষ্ট নামডাক করলে এদিকে দেবী অভয়ার প্রতি বিশেষ নজর দিতেন না । ফলে দেবী ক্ষিপ্ত হয়ে একদিন হরিপদবাবুকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে বলেন পূজো পরিচালনা করলেও হরিপদবাবু বা তাঁর বংশের কেউ তাঁর মুখ দর্শন করতে পারবেন না । মুখ দর্শন করলেই পরিবারে দুর্দৈব নেমে আসবে । সেই থেকে হরিপদবাবু বা তাঁর পরিবারের কেউ দেবীর মুখ দর্শন করতে পারতেন না ।’কাইগ্রামের দেবী অভয়া খুবই জাগ্রতা । দূর্গাপূজোর চারদিন ধরে দুরদুরান্ত থেকে শ্রদ্ধালুরা দেবীর পূজো দিতে আসেন বলে তিনি জানান ।
জানা যায়,খড়ি নদী থেকে হরিপদবাবুর সংগ্রহ করা পাটাতনেই এখনও দেবীর মূর্তি নির্মান করা হয় । প্রথমে একটি মাটির ঘরে দেবীর পূজো হত । পরে মাসডাঙ্গা পাড়ায় একটি পাকা মন্দির নির্মান করে দেন হরিপদ দত্ত । পাকা ঘর হলেও দেবীর নির্দেশ মত মাটির বেদির উপরেই দেবী মূর্তিকে রাখা হয় । দেবীর সেবাইত সমীর চক্রবর্তী জানান,ওই বেদিটি আসলে একটি পঞ্চমুন্ডির আসন । শোনা যায় বৃটিশ আমলে এক সাধক ওই আসনটি প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন বলে তিনি জানান ।
দেবী অভয়ার অপর এক সেবাইত কুন্তল চক্রবর্তী বলেন, ‘সাত পুরুষ আগে মহেন্দ্র পন্ডিত নামে আমাদের বংশের এক পূর্বপুরুষ মায়ের ধ্যানমন্ত্র লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন । আজও সেই মন্ত্রেই মায়ের পূজো হয় ।’পাশাপাশি তিনি জানান, দেবীপক্ষের শুরুতে প্রতিপদের দিন দেবীর ঘট আসে । ওইদিন চাল কুমড়ো বলি হয় । সপ্তমীর,নবমী ও দশমীর দিন চালকুমড়ো ও ঝিঙা বলিদান হয় । কেবল অষ্টমীর দিন ছাগবলি দেওয়া হয় । এছাড়া মাকে সিদ্ধি ভোগ দিতে হয় । পূজোর চারদিন ধরে গাওয়া গিয়ে ভাজা এক কেজি আড়াই’শ গ্রাম ময়দার ভোগ, ১ কেজি ২৫০ গ্রাম করে ছানা ও ক্ষীর ভোগ দেওয়া হয় মা’কে ।
দেবী অভয়ার সেবাইতরা জানিয়েছেন,হরিপদ দত্তর বংশধররা বহুকাল আগে থেকেই পূজো পরিচালনা করা ছেড়ে দিয়েছেন । গ্রামবাসীরাই দেবীর নিত্যসেবা ও বার্ষিক পূজো চালায় । প্রথম দিকে দু’এক বছর পূজোর খরচের জন্য টাকা পাঠাতেন হরিপদবাবুর বংশধররা । পরে সেটাও বন্ধ করে দেন । তারপর থেকেই কাইগ্রাম,রাউতগ্রাম,দুয়ারি, ব্রহ্মপূর প্রভৃতি গ্রামের শ্রদ্ধালুদের দানের অর্থে পূজো পরিচালনা হয় । বাৎসরিক পূজোর সময় অন্নভোগের আয়োজন করা হয় । আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রায় ১০ হাজার শ্রদ্ধালু ভোগ গ্রহন করতে আসেন বলে জানা গেছে ।।