এইদিন ওয়েবডেস্ক,ভাতার(পূর্ব বর্ধমান),২৫ ডিসেম্বর : “অর্শ” (Piles বা Haemorrhoids) হলো মলদ্বার বা পায়ু অঞ্চলের চারপাশের শিরার ফোলা ও প্রদাহ । অধিকাংশ রোগী লজ্জায় এই রোগ গোপন করে যান । যা পরবর্তী সময়ে আরও গুরুতর হয়ে হয়ে ওঠে এবং জটিল আকার ধারন করে । বিশেষ করে মলত্যাগের সময় প্রবল রক্তপাতে রোগীরা হতাশায় পর্যন্ত ভোগেন । এটি অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক—দুই ধরনের হয় এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন ও কিছু ঘরোয়া পদ্ধতিতে এর উপশম সম্ভব, তবে গুরুতর ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। কিন্তু অস্ত্রোপচারের পরেও অর্শ রোগ নির্মুলের গ্যারান্টি দিতে পারেন না চিকিৎসকরা । তবে ভেষজ চিকিৎসায় এই রোগ নির্মূল করা সম্ভব বলে দাবি করা হয় ।
এমনই এক ভেষজ চিকিৎসা শিবির বিগত প্রায় দুই দশক ধরে করে আসছেন পূর্ব বর্ধমান জেলার ভাতার থানা এলাকার ভাতার, কুলচন্ডাসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের কিছু মানুষ ৷ প্রতি বছর ২৫শে ডিসেম্বর তারা ভাতার মাধব পাবলিক হাইস্কুলের “অর্শ নির্মূল শিবির”-এর আয়োজন করে আসছেন । ” ভাতার তরুন হাজরা সেবা সমিতি”র ব্যানারে এবারেও তারা এই শিবিরের আয়োজন করেছেন । আজ বৃহস্পতিবার আয়োজিত এই শিবির ছিল রোগীদের ভিড়ে ঠাসা ।
জানা গেছে,মুর্শিদাবাদের ফারাক্কার দুই চিকিৎসক ডঃ মিলন দাস ও ডঃ শুভঙ্কর গুপ্তা গতকাল রাতেই ভাতারে পৌঁছে যান । ভাতারে রাত্রিবাসের পর সকাল থেকেই তারা চিকিৎসা শুরু করেছেন । চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে পার্থ সারথি হাজরা,অঞ্জন মল্লিকরা বলেন, ‘প্রথমে একটি বিশেষ ভেষজ ইঞ্জেকশন রোগীর পাইলসের মুখে মুখে পুশ করা হয় । একজনের একাধিক অর্শ মুখ থাকতে পারে । মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ইঞ্জেকশনের রোগীকে সর্ষের তেল ও রসুন সহযোগে বিশেষ প্রকার অ্যান্টিসেপ্টিক মিশ্রন তৈরি করে নিতে বলা হয় । যেটি ড্রপারের সাহায্যে দিনে অন্তত তিনবার রোগীর মলদ্বারে পুশ করতে হবে । তবে চিকিৎসকরা অন্য কাউকে দিয়ে ওই বিশেষ তেল পুশ করার পরামর্শ দেন ।’ তবে ওই ভেষজ ইঞ্জেকশন ওষুধের দোকানে পাওয়া যায়না,বরঞ্চ চিকিৎসকরা বিশেষ গাছগাছড়ার সাহায্যে বাড়ি থেকে তৈরি করে নিয়ে আসেন বলে জানিয়েছেন তারা ।
উদ্যোক্তরা জানিয়েছে,ইঞ্জেকশন নেওয়ার পর ৭ দিন থেকে এক মাস পর্যন্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে । এমনকি মলদ্বার থেকে মাংপিন্ডও খসে পড়তে পারে । তাতে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারন নেই । ওই বিশেষ তেলের মিশ্রণ লাগাতে লাগাতে একদিকে যেমন রক্তপাত কমবে,পাশাপাশি ক্রমশ মিলিয়ে যাবে অর্শের মুখ । তবে এই চিকিৎসা শুরুর পর একমাস খাওয়া দাওয়ার বিষয়ে কিছু নিষেধাজ্ঞা রয়েছে৷ তার মধ্যে অন্যতম হল মাছ-মাংস-ডিম খাওয়া বন্ধ রাখতে হবে । বিড়ি কলাইয়ের ডাল খেতেও নিষেধ করা হয় । খেতে নিষেধ করা হয় বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় “পোস্ত”র তরকারি । কারন পোস্তকে কোষ্ঠকাঠিন্যের অন্যতম কারন বলে মনে করা হয় । এই চিকিৎসায় অর্শ রোগের নিরাময়ের হার ৯৫ শতাংশ বলে দাবি করেছেন উদ্যোক্তারা ।
পার্থ সারথি হাজরা বলেন,’ফারাক্কায় ডাক্তারবাবুদের চেম্পারে গিয়ে চিকিৎসা করালে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত ফি লাগে । যেখানে এলাকার মানুষদের স্বার্থে আমরা বিশেষ ছাড়ে মাত্র ২০০০ টাকায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করি ।’ পাশাপাশি ওষুধ, রোগী ও রোগীদের টিফিন, চাসহ আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা বিনামূল্যে আয়োজন করা হয় বলে জানিয়েছেন পার্থ সারথিবাবু । জানা গেছে, স্থানীয় যুবক তরুন হাজরার অকাল মৃত্যুর পর তার স্মৃতিতে “ভাতার তরুন হাজরা সেবা সমিতি” গঠন করে ২০১৭ সাল থেকে “অর্শ নির্মূল শিবির” শুরু করেন পার্থ সারথিবাবুরা । সেই সময় ভাতার ও কুলচন্ডা গ্রাম মিলে স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা ছিল ২৫ জন । তারপর থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে এযাবৎ এই শিবির চালিয়ে আসছেন তারা । বর্তমানে অর্ধ শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক রয়েছেন বলে জানিয়েছেন পার্থ সারথিবাবু ।
কিন্তু এই চিকিৎসা কতটা বিজ্ঞান সম্মত?
এই বিষয়ে শিলিগুড়ি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অবসরপ্রাপ্ত ক্যান্সার রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডঃ পিনাকী হাজরা বলেন, ‘এই চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে আমার বিশেষ কোনো ধারনা নেই । তবে রাজ্যের অনেক সরকারি হাসপাতালে আয়ূর্বেদিক চিকিৎসা হয় । আমি যখন রূপনারায়নপুর হেলথ সেন্টার কর্মরত ছিলাম,তখন সেখানেও আয়ূর্বেদিক চিকিৎসা করতে দেখেছি । চিকিৎসারা অর্শ রোগীদের এভাবেই ইঞ্জেকশন দিতেন ।’ এলোপ্যাথিক চিকিৎসাতেও অস্ত্রপচারের আগে ইঞ্জেকশন দেওয়া হয় বলে তিনি জানান ।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা জানান, অর্শ সাধারণত কোষ্ঠকাঠিন্য, দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা বা দাঁড়িয়ে থাকা, গর্ভাবস্থা,পায়ূ সঙ্গম এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণে হয় । এই রোগের ফলে মলদ্বারে ব্যথা, চুলকানি, ফোলাভাব ও রক্তপাত হতে পারে । দীর্ঘ দিন এই রোগ পুষে রাখলে রক্তাল্পতা, অ্যানিমিয়া, রক্ত জমাট বাঁধা ( থ্রম্বোসিস), সংক্রমণ, ত্বকের অতিরিক্ত বৃদ্ধি ( স্কিন ট্যাগ), এবং অতিরিক্ত ব্যথাসহ স্ট্র্যাংগুলেটেড হেমোরয়েডের মতো রোগ বা জটিলতা হতে পারে, যা মলদ্বারে তীব্র ব্যথা, চুলকানি, অস্বস্তি, ফোলাভাব এবং মলত্যাগের সময় রক্তপাত ঘটাতে পারে । তবে মলদ্বারে রক্তপাত বা অন্য কোনো সমস্যা দেখা দিলে অর্শ ভেবে উপেক্ষা করা উচিত নয়, কারণ এটি কোলোরেক্টাল ক্যান্সার বা অন্যান্য গুরুতর রোগের লক্ষণও হতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।।

