এইদিন ওয়েবডেস্ক,ভাতার(পূর্ব বর্ধমান),২৩ ডিসেম্বর : গত শনিবার রাতে ভগবানপুর সাউথ পয়েন্ট পাবলিক স্কুলের অনুষ্ঠানে ৬-৭টি গান গাওয়ার পরে দেবী চৌধুরানী সিনেমার ‘জাগো মা’ গানটি গাইছিলেন লগ্নজিতা চক্রবর্তী । কিন্তু ওই গানটি স্কুলের অন্যতম মালিক মেহেবুব মালিকের আদপেই পছন্দ হয়নি ৷ তিনি মঞ্চে উঠে কার্যত মারমুখি হয়ে শিল্পির কাছে “সেকুলার গান” গাওয়ার ‘ফতোয়া জারি’ করেন৷ শিল্পি ভগবানপুর থানায় এনিয়ে অভিযোগ জানাতে গেলে অসহযোগীর অভিযোগ উঠেছে ওসি শাহেনশাহ হকের বিরুদ্ধেও । যদিও জেলার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার মিতুনকুমার দে’র হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয় ।
এই ঘটনার জের মিটতে মা মিটতেই আরও এক সঙ্গীতশিল্পিকে শাসকদলের রোষানলে পড়তে হল বলে অভিযোগ । আর ওই শিল্পি হলেন পল্লব কীর্তনিয়া৷ আগামী কাল বুধবার(২৪ ডিসেম্বর) থেকে ৩০ শে ডিসেম্বর পর্যন্ত পূর্ব বর্ধমানের ভাতার মাধব পাবলিক হাইস্কুলের মাঠে “বইমেলা ও ভাতার উৎসেব”-এর আয়োজন করা হয়েছে । এই বইমেলায় আগামী ২৫ ডিসেম্বর বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী পল্লব কীর্তনিয়ার একটি গানের অনুষ্ঠান ছিল । শিল্পিকে তার পারিশ্রমিকের বায়না করেও শেষ মুহুর্তে শাসকদলের চাপে অনুষ্ঠানটি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ । যা নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক বিতর্ক ।
আজ মঙ্গলবার ফেসবুক পোস্ট করে কোনো কারন ছাড়াই তার অনুষ্ঠান বাতিল করে দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিল্পি পল্লব কীর্তনিয়া । তিনি ফোনে বলেছেন,’আমার সাথে এই রকম ঘটনা দীর্ঘদিন ধরেই হয়ে আসছে। যবে থেকে আমার ‘প্রশ্ন কোরো না’ গানটি ভাইরাল হয়েছে, তখন থেকেই আমার একের পর এক অনুষ্ঠান বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি গানমেলাতে পর্যন্ত আমায় আর ডাকা হয় না ।’ তিনি আরও বলেন,পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সহযোগিতায় আয়োজিত একটি মেলায় আমায় গান গাওয়ার জন্য বায়না করায় সন্দেহ হয় । তাই আমি আয়োজকদের প্রশ্ন করেছিলাম তারা সত্যিই কি আমার অনুষ্ঠান করতে চান কী না? তারা সম্মতি দেন এবং সম্মানদক্ষিণা সংক্রান্ত সব কিছু পাকা হয়ে গিয়েছিল । কিন্তু আজ হঠাৎ আয়োজকরা আমায় ফোন করে জানিয়ে দেয় যে আমার অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে৷’ যদিও বাতিল করার সুনির্দিষ্ট কারন তারা ব্যাখ্যা করেনি বলে জানান তিনি ।
জানা গেছে,ভাতারে যে মাঠে বইমেলার আয়োজন হতে চলেছে, তার নাম দেওয়া হয়েছে “জীবনানন্দ দাস প্রাঙ্গন”৷ এই মেলায় বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছে । অনেক শিল্পিকে বায়নাও করা হয়েছে৷ যার মধ্যে সংগীতশিল্পী পল্লব কীর্তনিয়ার অনুষ্ঠানটি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে । একজন প্রতিবাদী শিল্পীর অনুষ্ঠান বাতিলের তীব্র সমালোচনা করেছেন স্থানীয় বিজেপি নেতা মৃত্যুঞ্জয় চন্দ্র । তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে যা হচ্ছে এবারে এখানেও শুরু হবে। শিল্প সমাজের দর্পন। কিন্তু এ রাজ্যে শিল্পীরা সমাজের অনাচার তুলে ধরতে পারছেন না। তৃণমূল কংগ্রেসের এটাই সংস্কৃতি ।’
প্রসঙ্গত,পল্লব কীর্তনিয়ার “প্রশ্ন করো না” গানটি বেশ কয়েক বছর আগের । রাজ্যে ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতনের ঘটনা ও শাসকদলের দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদে স্বরচিত গান গেয়েছিলেন ওই শিল্পি । যেকারণে তাকে শাসকদলের রোষানলে পড়তে হয় বলে অভিযোগ । আর তার ভাতারের অনুষ্ঠান বাতিলের জন্যও সেই রোষ কাজ করেছে বলে মনে করছেন তিনি । যদিও ভাতার বইমেলা ও উৎসবের আয়োজক মধুসূদন কোঙার সাফাই হল, ‘শাসকদলের তরফে আমাদের কোনো চাপ দেওয়া হয় নি। আসলে আমরা যে পরিমাণ বিজ্ঞাপন পাবো ভেবেছিলাম তা পাইনি। তাই ওনার যথাযথ পারিশ্রমিক জোটাতে পারব না বলেই ওনার অনুষ্ঠান বাতিল করে দিতে বাধ্য হয়েছি ।’ যদিও আয়োজকের এই দাবি সত্যি নয় বলে মনে করছেন অনেকে৷ কারন অনুষ্ঠানটি রাজ্যের গ্রন্থগার দপ্তরের সহযোগিতায় আয়োজন করা হচ্ছে । অনুষ্ঠান স্থল ছাড়াও বর্ধমান- কাটোয়া রাজ্য সড়কের উপর বিশাল গেট নির্মান করা হয়েছে । রয়েছে এলাহি আয়োজন । এত আয়োজনের খরচ যদি তারা জোটাতে পারেন তাহলে একটা শিল্পির মাত্র কয়েক হাজার টাকা পারিশ্রমিকও তারা দিতে পারতেন বলে মনে করছেন অনেকে ।
যদিও আয়োজকদের সুরেই সুরে সুর মিলিয়ে পল্লব কীর্তনিয়ার অনুষ্ঠান বাতিলে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক বাগবুল ইসলাম। তার কথায়,’ঠিক কী কারণে ওই অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে তা আয়োজকরা বলতে পারবেন । তবে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে এর কোনোও যোগ নেই। আমাদের দল শিল্পীর স্বাধীনাতায় বিশ্বাস করে। সকলের নিজের মত প্রকাশের অধিকার রয়েছে।’
তবে শিল্পি পল্লব কীর্ত্তনীয়া ফেসবুকে লিখেছেন,’এ নিয়ে আমি বলি না আর কিছুই কারণ আমি জানি শাসকের বিরুদ্ধে গাইলে শাসক প্রত্যাঘাত করবেই। আর যখন মূল ইন্ডাস্ট্রির শিল্পীকূল থেকে আমি পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন, নেহাতই একা, তাই সইতে হবে একাই! তবে এটুকু বলা ভালো আজ যারা মঞ্চে নিয়মিত অনুষ্ঠানে ডাক পাচ্ছেন তারা শাসকের সুনজরে আছেন বলেই পাচ্ছেন। শিল্পীর স্বাধীনতা আছে কতটুকু সেটা শাসকের সুনজরের বলয়ে থেকে বোঝা অসম্ভব। শাসকের এই সকল চুরি, দুর্নীতি, ফেরেব্বাজি, ধর্মবাজি নিয়ে একটা গান করলে তখন বোঝা যাবে শিল্পীর স্বাধীনতা কতটুকু এ রাজ্যে।’
তিনি আরও লিখেছেন,’লগ্নজিতার পাশে এসে সঙ্গত কারণে দাঁড়িয়েছেন যে শিল্পীরা তাঁদের আমার পাশে দাঁড়াতে বলার মত দেউলিয়া হয়ে যাইনি এখনো। তবে চুরির সাম্রাজ্য বিস্তার করা এই রাজ্যে সমাজের শিরদাঁড়া শিক্ষাব্যবস্থাকেও ধ্বংস করে দিল একটা নির্বাচিত সরকার! দুর্নীতি করে করে, পকেট ভরে ভরে আস্ত যে একটা প্রজন্মকে শেষ করে দিল, অন্তত তাঁদের জন্য দোহাই একটা গান করুন। নিজের বিবেকের পাশে দাঁড়ান, অন্তত একটিবার!’।

