এইদিন ওয়েবডেস্ক,হুগলি,২০ ডিসেম্বর : মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির কারনে তাদের “চোরের দল” আখ্যা দিয়েছে বিজেপি । শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি, রেশন দুর্নীতি, বালি-কয়লা পাচার, গরু পাচার, তোলাবাজি,কাটমানি প্রভৃতি ভুরি ভুরি অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছে মমতা ব্যানার্জির ‘প্রিয় ভাইদের’ নাম৷ কোনো দুর্নীতিতে সরাসরি কালীঘাটের যোগের কথা বলে আসছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী । তবে বিজেপি রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল হওয়ায় স্বভাবতই এই অভিযোগগুলো “মিথ্যা” বলে উড়িয়ে দিয়েছে শাসকদল । কিন্তু খোদ তৃণমূলের এক বিধায়ক যখন দলের এই সমস্ত “চৌর্যবৃত্তি” নিয়ে সরব হন, তখন মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে ।
নিজের দলেরই “চৌর্যবৃত্তি” নিয়ে সরব হওয়া এমনই এক ব্যক্তিত্ব হলেন হুগলি জেলার বলাগড়ের তৃণমূল বিধায়ক তথা সাহিত্যিক মনোরঞ্জন ব্যাপারী (Manoranjan Byapari)। বালি পাচার থেকে শুরু করে র্যাশন সামগ্রী চুরি— এলাকার যাবতীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়ে এবার নিজের দলেরই একাংশের রোষানলে পড়েছেন তিনি । আজ শনিবার তিনি এনিয়ে ফের সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হয়েছেন । তিনি স্পষ্ট অভিযোগ করেছেন যে কাটমানি আর পাচারের টাকা নেতাদের পকেটে ঢুকতে বাধা দিয়েছেন বলেই আজ তাঁকে ব্রাত্য করে রাখা হচ্ছে। নিচে তৃণমূল বিধায়ক মনোরঞ্জন ব্যাপারীর ফেসবুক পোস্টটি তুলে ধরা হল :
“ভাবছিলাম কথা গুলো লিখব না। কিন্তু অনেকেই এত জ্বালাতন করছে যে না লিখেও পারছি না।
অনেকে বলছে, বলাগড়ের একই মাঠে দুটি মিটিং হয়ে গেল একটা বিজেপি একটা তৃনমূলের। আপনি বিধায়ক অথচ দুটোর কোনটায় আমন্ত্রন পেলেন না এটা কেমন কথা!
ভাই হে, আমি তৃণমূল বিধায়ক তাই বিজিপির মিটিংয়ে আমন্ত্রন পাবোনা, আবার পেলেও যাবো না এটা তো জানা কথা। রইল বাকি তৃনমূল! ভাই রে, গত সাড়ে চার বছর ধরে বলাগড়ে আমি যে সব কাজ করেছি আপনাদের কি মনে হয় সেগুলো অঞ্চলের নেতাদের পক্ষে খুব সুখকর আনন্দদায়ক?
সরকারের কাছ থেকে যেসব ত্রিপল কম্বল কাপড় চোপড় পেয়েছি সেগুলো আমি কোন আঞ্চলিক নেতার হাতে না দিয়ে নিজে ঘুরে ঘুরে গরীব মানুষদের মধ্যে বিতরণ করেছি। নেতাদের কাছে ৫০ টা দিলে ৪০ টা নিজের জন্য রেখে দশটা বিলি করার এত কালের যে সুখ, সেই যে সুখ আনন্দ তা থেকে আমি তাদের বঞ্চিত করেছি। এটা একটা অপরাধ।
চার বছর এলাকার মাটি কামড়ে পড়ে থেকে রাত রাত জেগে প্রানের মায়া ত্যাগ করে অবৈধ মাটি উৎখনন বালি পাচার অনেকটাই রুখে দিতে সমর্থ হয়েছি।
আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাই আমি আসবার আগে কোন বছরই মাটির রাজস্ব বাবদ সরকারের রাজস্ব খাতে কুড়ি পঁচিশ লাখ টাকার বেশি জমা পড়ত না। আমার প্রচেষ্টায় সেটা ১ কোটি ৭৫ লক্ষ হয়েছিল। যে টাকা অঞ্চলের নেতাদের পকেটে যেত সেটাকেই বাধ্য করেছিলাম সরকারের ঘরে জমা দিতে। এর ফলে তাবড় তাবড় নেতা আমার উপর ক্ষুব্ধ। গুপ্তিপাড়াতে বালি পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আমাকে কি করতে হয়েছিল সেটা তো একটা ইতিহাস হয়ে রয়েছে। এখনো গুপ্তিপাড়া ঘাটের বহু মানুষ সেই…. আওয়াজ ভুলতে পারেনি।
এলাকার গরু পাচার, গাজা পাচার, রেশনের মাল পাচার, জুয়ার বোর্ড সবগুলোর বিরুদ্ধেই আমি যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। দিনের পর দিন সবুজদ্বীপ থেকে রাতের অন্ধকারে যেসব বিশাল বিশাল গাছ কেটে পাচার হচ্ছিল সেটাকে আটকেছি।
এর ফলে যারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা কারা বলাগড়বাসী সমস্ত মানুষ জানে। সেই মানুষরা যদি কোন মিটিং করে – তারা জানে আমার জিভে কোন তালা দেওয়া নেই । ওই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমি কি না কি বলে দেব তাতে তারা বিড়ম্বনায় পড়ে যাবে। তাই আমাকে আজকাল আর কোন মিটিংয়ে ডাকা হয় না।
আমি অতি তুচ্ছ মানুষ। বিধায়ক হবার মত কোনো যোগ্যতা আমার ছিলনা। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন নিষ্ঠা সহকারে সততা সঙ্গে সাড়ে চার বছর আমি সেই দায়িত্ব পালন করেছি। দীর্ঘ জীবনের সুনামের গায়ে একটাও কালির আঁচড় লাগতে দেইনি।মাত্র কয়েকটা দিন আর বাকি আছে । এভাবেই এই কটাদিন পার করে দিতে পারলেই হলো।
রইল বাকি পরের বারের বিধায়ক টিকিট! সে উনি দিলে দেবেন না দিলে না দেবেন । এর জন্য আমার কোন দুঃখ আক্ষেপ নেই। রাজনীতিটা আমার কাছে চাকরি ব্যবসা করে কম্মে খাওয়ার জায়গা নয়। বিধায়ক গিরি করা ছাড়াও আমার কাছে জনসেবা করার জন্য অনেক প্লাটফর্ম আছে। তখন সে গুলো করব।” সব শেষে তিনি লিখেছেন,”আমার যা বলার বলে দিলাম। এই বিষয়ে আর আমাকে কেউ কোন প্রশ্ন করবেন না।”
প্রসঙ্গত,এমনিতেই রাজ্যে প্রতিষ্ঠান বিরোধী ব্যাপক হাওয়া চলছে । তার উপর ভোটব্যাঙ্কের ধর্মীয় মেরুকরণের স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে । পাশাপাশি ভোটার তালিকায় বিপুল অবৈধ ভোটারের নাম বাদ যেতে চলেছে । এখনো পর্যন্ত সংখ্যাটা প্রায় ৫৯ লাখ । কিন্তু শুনানির জন্য আরও প্রায় দুই কোটি ভোটারকে নির্বাচন কমিশন ডাকবে বলে খবর৷ ফলে এরাজ্যে এসআইআর-এ ঠিক কত সংখ্যক ভোটারের নাম বাদ যেতে চলেছে সেটা এখনো স্পষ্ট নয় ।
নির্বাচন কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী শুধুমাত্র তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জির জেলা দক্ষিণ ২৪ পরগণায় এখনো পর্যন্ত ৮ লক্ষের অধিক নাম বাদ চলে গেছে । যেখানে তার জয়ের মার্জিন ছিল ৭ লাখের অধিক । ফলে,রাজ্যের বিভিন্ন বিধানসভা আসনে যে পরিমান ভুয়ো ভোটারের নাম বাদ যাচ্ছে, তাতে আসন্ন বিধানসভার ভোটের লড়াই তৃণমূলের জন্য কঠিন হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে । তার উপর প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া,ধর্মীয় মেরুকরণ ও দলীয় নেতাদের উলটো সুর তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জিকে আরও বিপাকে ফেলে দিয়েছে । এখন মমতার ভাড়া করা ভোটকুশলী বেসরকারি সংস্থা “আই প্যাক” এই পরিস্থিতিকে কতটা “ম্যানেজ” করতে পারে সেটাই দেখার বিষয় ।।

