‘কেন’ (Kena) শব্দের অর্থ ‘কে বা কী দ্বারা’। এটিকে ‘তলবকার উপনিষদ’ও বলা হয় কারণ এটি সামবেদের তলবকার ব্রাহ্মণ থেকে নেওয়া হয়েছে। এটি কয়েকটি অধ্যায়ে বিভক্ত, যেখানে প্রথম দুটি অধ্যায় মূলত ব্রহ্মবিদ্যা এবং পরবর্তী অংশগুলিতে (তৃতীয় ও চতুর্থ) হৈমাবতী উপাখ্যান রয়েছে। ‘কেন উপনিষদ – প্রথম খন্ড’-এর মূল বিষয় হলো জ্ঞানের উৎস এবং ব্রহ্মের স্বরূপ অনুসন্ধান, যেখানে প্রশ্ন করা হয়েছে—”কে বা কী দ্বারা চালিত হয়ে মন কাজ করে?” “কে আমাদের চোখ-কানকে নিয়ন্ত্রণ করে?”। এই খন্ডে শঙ্করাচার্যের ভাষ্য অনুযায়ী ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, আত্মা বা ব্রহ্ম কোনো ইন্দ্রিয় (যেমন চোখ, কান) বা মনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, বরং এরাই ব্রহ্ম দ্বারা প্রকাশিত; ব্রহ্মই সেই পরম সত্তা যা জানা বা না-জানার ঊর্ধ্বে, এবং এই সত্য উপলব্ধির মাধ্যমে মোক্ষ লাভ হয়, যা ইন্দ্রিয় বা বাক্য দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়, বরং একটি অভ্যন্তরীণ জাগরণ।
প্রশ্ন: মন, প্রাণ, চোখ, কান ইত্যাদি কীভাবে কাজ করে? এই সমস্ত ইন্দ্রিয় ও কর্মের চালিকা শক্তি কে?উত্তর: ইন্দ্রিয়গুলো ব্রহ্মের দ্বারা চালিত। ব্রহ্ম হলো সেই ‘জানা’ বা ‘জানার কর্তা’ যা এই ইন্দ্রিয়গুলোরও উৎস, কিন্তু নিজে কোনো ইন্দ্রিয় নয়।
উপসংহার: এই সত্য উপলব্ধি করা যে, ব্রহ্মই সমস্ত কিছুর উৎস এবং তা বাইরের কোনো শক্তি নয়, বরং আমাদের নিজস্ব আত্মার গভীরে অবস্থিত, যা আমাদের ইন্দ্রিয় ও মনের অতীত—এটাই প্রথম খন্ডের মূল শিক্ষা, যা অদ্বৈত বেদান্তের ভিত্তি স্থাপন করে।
॥ অথ কেনোপনিষদ ॥
1) কেনেষিতং পততি প্রেষিতং মনঃ।
কেন প্রাণঃ প্রথমঃ প্রৈতি য়ুক্তঃ।
কেনেষিতাং বাচমিমাং বদন্তি।
চক্ষুঃ শ্রোত্রং ক উ দেবো য়ুনক্তি ॥
অর্থ:- (শিষ্য)—কার ইচ্ছায় মন বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হয়? প্রাণের প্রথম লক্ষণ, শ্বাসবায়ু, কার নির্দেশে কাজ করে? কার নির্দেশে মানুষ কথা বলে? চোখ, কান [এবং অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে] কোন্ দেবতা চালনা করেন?
2) শ্রোত্রস্য শ্রোত্রং মনসো মনো য়ত্।
বাচো হ বাচং স উ প্রাণস্য প্রাণঃ।
চক্ষুষশ্চক্ষুরতিমুচ্য ধীরাঃ।
প্রেত্যাস্মাল্লোকাদমৃতা ভবন্তি ॥
অর্থ:- (আচার্য)—এই (ব্রহ্মই) কানের প্রকৃত কান, মনের যথার্থ মন, কথার প্রকৃত শক্তি, শ্বাসের প্রকৃত শ্বাস, চোখের প্রকৃত চোখ। তাই জ্ঞানীরা দেহে আত্মবুদ্ধি না করে এই জগৎকে ত্যাগ করেন এবং অমর হয়ে যান।
3) ন তত্র চক্ষুর্গচ্ছতি ন বাগ্গচ্ছতি নো মনো
ন বিদ্মো ন বিজানীমো য়থৈতদনুশিষ্যাৎ ॥
অর্থ:- ব্রহ্ম যেখানে, সেখানে আমাদের দৃষ্টি পৌঁছতে পারে না। তা আমাদের বাক্য এবং মনেরও অতীত। আচার্য এ দুরূহ তত্ত্ব কিভাবে শিষ্যের কাছে ব্যাখ্যা করেন তা আমরা জানি না।
4) অন্যদেব তদ্বিদিতাদথো অবিদিতাদধি।
ইতি শুশ্রুম পূর্বেষাং য়ে নস্তদ্ব্যাচচক্ষিরে ॥
অর্থ:- সব পরিচিত ও জ্ঞাত বস্তু থেকে ‘তৎ’ অর্থাৎ সেই ব্রহ্ম স্বতন্ত্র; ব্রহ্ম অজ্ঞাত বস্তু থেকেও স্বতন্ত্র। প্রাচীন (আচার্য) যাঁরা এই তত্ত্বের ব্যাখ্যাতা—আমরা তাঁদের কাছ থেকে একথা শুনেছি।
5) য়দ্বাচানভ্যুদিতং য়েন বাগভ্যুদ্যতে।
তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং য়দিদমুপাসতে ॥
অর্থ:- একমাত্র তাঁকেই ব্রহ্ম বলে জেনো যাঁকে বাক্য দিয়ে বর্ণনা করা যায় না, বরং যাঁর দ্বারা বাক্যই ভাব প্রকাশের মাধ্যম হয়ে থাকে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং সর্বজনপূজ্য জগৎ থেকে এই ব্রহ্ম স্বতন্ত্র।
6) য়ন্মনসা ন মনুতে য়েনাহুর্মনো মতম্।
তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং য়দিদমুপাসতে ॥
অর্থ:- একমাত্র তাঁকেই ব্রহ্ম বলে জেনো, মন যাঁকে বুঝতে পারে না কিন্তু ঋষিদের মতে যিনি মনকে কর্মক্ষম করেন। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং সর্বজনপূজ্য জগৎ থেকে এই ব্রহ্ম স্বতন্ত্র।
7) য়চ্চক্ষুষা ন পশ্যতি য়েন চক্ষূংষি পশ্যতি।
তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং য়দিদমুপাসতে ॥
অর্থ:-তিনিই ব্রহ্ম যাঁকে চোখ দিয়ে দেখা যায় না, কিন্তু যাঁর শক্তিতে চোখ দেখতে পায়। এই ব্রহ্ম কিন্তু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং সকলের উপাস্য জগৎ থেকে স্বতন্ত্র।
8) য়চ্ছ্রোত্রেণ ন শৃণোতি য়েন শ্রোত্রমিদং শ্রুতম্।
তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং য়দিদমুপাসতে ॥
অর্থ:-একমাত্র তাঁকেই ব্রহ্ম বলে জেনো যাঁকে কান দিয়ে শোনা যায় না, কিন্তু যাঁর শক্তিতে কান শুনতে পায়। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং সর্বজনপূজ্য জগৎ থেকে এই ব্রহ্ম স্বতন্ত্র।
9) য়ৎ প্রাণেন ন প্রাণিতি য়েন প্রাণঃ প্রণীয়তে।
তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং য়দিদমুপাসতে ॥
অর্থ:-একমাত্র তাঁকেই ব্রহ্ম বলে জেনো যিনি ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের গোচর নন, অথচ যাঁর শক্তিতে ঘ্রাণেন্দ্রিয় ঘ্রাণ নেয়, কাজ করে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং সর্বজনপূজ্য জগৎ থেকে এই ব্রহ্ম স্বতন্ত্র।
