মুর্শিদাবাদের ভরতপুরের বহিষ্কৃত তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক হুমায়ুন কবির বেলডাঙ্গায় “বাবরি মসজিদ”-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন ৷ তারপর থেকে বিষয়টি রাজ্য ছাড়িয়ে জাতীয় ইস্যু হয়ে গেছে । মুসলিমদের একটা বড় অংশ হুমায়ুন কবিরের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও, দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী এটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না । বঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীসহ বিজেপি নেতারা মুঘল সম্রাট বাবরকে “হিন্দুদের অত্যাচারী-ধর্ষক- মদ্যপ-লুন্ঠনকারী” হিসাবে চিহ্নিত করে বেলডাঙ্গায় বাবরের নামে মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের কঠোর বিরোধীতা করছেন । যদিও নাম নিয়ে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিএম ও কংগ্রেস এখনো আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনো প্রতিবাদ জানায়নি । তবে মধ্যযুগের এই মুঘল হানাদার ও নৃসংশ ঘাতককে নিয়ে ফের উতপ্ত হয়ে উঠেছে জাতীয় রাজনীতি৷
কে এই বাবর ?
“বাবর” বা জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম সম্রাট । তিনি মধ্য এশিয়ার একজন তিমুরিদ রাজপুত্র ছিলেন এবং তৈমুর ও চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন । তৈমুর ও চেঙ্গিস খান দু’জনেই তাদের নৃশংসতার জন্য কুখ্যাত । বাবর ১৫২৬ সালে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করে ভারতে মুঘল শাসনের ভিত্তি স্থাপন করেন । ১৪৮৩ সালে বর্তমান উজবেকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন বাবর এবং ১৫৩০ সালে দিল্লির আগ্রায় মারা যান। আগ্রাতে তাকে কবরও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মারা য়াওয়ার প্রায় ১৩ বছর পরে কবর থেকে মৃত দেহ তুলে নিয়ে গিয়ে নতুন করে করব দেওয়া হয়েছিল আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে ।
অনেকে মন্তব্য করেন যে বাবরের দেহ নতুন করে কাবুলে কবরস্থ করায় এক অর্থে ভারতের জন্য ভালোই হয়েছে । তারা কটাক্ষ করেন, বাবরের সমাধি ভারতে থাকলে হয়ত ওই হানাদারকে মহিমান্বিত করতে বিশাল স্মৃতিসৌধ তৈরী করা হত । এমনকি ছুটির দিনও ঘোষণা করা হত ! তাদের এই সন্দেহের কারন হল কংগ্রেস ও বামপন্থীদের “বাবর প্রেম” । আর কংগ্রেসের বাবর প্রেমের প্রমান মেলে জহরলাল নেহেরু থেকে শুরু করে বর্তমান রাহুল গান্ধী পর্যন্ত কাবুলে গিয়ে বাবরের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসার মধ্য দিয়ে ।
আসলে,কংগ্রেস দলের শাসক বংশের মনে হয় মুঘল সম্রাটের প্রতি এক ধরণের আকর্ষণ ছিল। বাস্তবে, কংগ্রেসের রাজবংশের চার প্রজন্মের শাসকরা তার সমাধি পরিদর্শন করেছেন। জওহরলাল নেহেরু ১৯৫৯ সালে, ইন্দিরা গান্ধী ১৯৬৮ সালে,১৯৭৬ সালে রাজীব গান্ধী এবং রাহুল গান্ধী ২০০৫ সালে আফগানিস্তানে বাবরের সমাধি পরিদর্শন করেছিলেন।
ইন্দিরা গান্ধীও কাবুলে বাবরের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানান। প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী এবং তৎকালীন আমলা নটবর সিং তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন , “ভারতের প্রধানমন্ত্রী সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, মাথা সামান্য নিচু করে, তাঁকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছিলেন। আমি তাঁর থেকে কয়েক পা পিছনে ছিলাম। এটি ছিল লালন করার, স্মরণ করার এবং মনে রাখার মতো একটি মুহূর্ত। সেই মুহূর্তে শতাব্দীগুলি মিশে এবং ঝাপসা হয়ে গেল।” তিনি আরও বলেন, “এক মিনিট পর তিনি পিছিয়ে এসে বললেন, ‘আমাদের ইতিহাসের সাথে আমাদের ঝগড়া হয়েছে’। আমি বললাম, ‘আমার দুটি হয়েছে।’ ‘তুমি কী বলতে চাইছো?’ ‘বাবরের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো নিজেই একটি উপলক্ষ ছিল,’ আমি বললাম, ‘কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তা করা ছিল সবচেয়ে বিরল সুযোগ’।”
২০০৫ সালে, রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সাথে আফগানিস্তান সফরে গিয়েছিলেন। রাহুল গান্ধী সর্বত্র মনমোহনের সাথে ছিলেন, তৎকালীন আফগান রাষ্ট্রপতি হামিদ কারজাইয়ের সাথে সাক্ষাত এবং বাবরের সমাধি পরিদর্শন সহ।
আরএসএস-এর সাথে যুক্ত, অর্গানাইজার প্রায়শই মুঘল রাজবংশের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আপত্তি তুলেছে। ২০১৯ সালে তাদের প্ল্যাটফর্মে একটি নিবন্ধে বলা হয়েছিল , “কখনও ভেবে দেখেছেন কেন গান্ধী পরিবারের প্রতিটি বংশধর কেন মুঘল সম্রাট বাবরের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সুদুর কাবুলে তার সমাধিতে ফুল অর্পন করতে কখনও ভোলেননি? কখনও ভেবে দেখেছেন কেন নব্য পৈতেধারী শিবভক্ত কয়েক মিটার দূরে অবস্থিত একজন হিন্দু রাজার সমাধিতে যাওয়ার বিষয়ে কখনও দ্বিধা করেননি?”প্রবন্ধটিতে আরও জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, “রাহুল গান্ধী ওরফে ‘জানেউ ধরি’ শিবভক্তকে ফাঁস করার সময় এসেছে। কেন তারা লক্ষ লক্ষ হিন্দুর খুনি এবং আমাদের মন্দির লুণ্ঠনকারীকে প্রণাম জানাবে? কেন আজও, অযোধ্যার শ্রী রাম মন্দির ধ্বংসকারী জহিরউদ্দিন বাবর নেহেরু-গান্ধী রাজবংশের সদস্যদের আকর্ষণ করে এবং অনুপ্রাণিত করে?”
২০২১ সালের আগস্টে ‘দ্য এম্পায়ার’ শিরোনামের একটি ওয়েব সিরিজের মাধ্যমে হটস্টার বাবরের গণহত্যার প্রবণতাকে সাদা করার জন্য প্রচারণামূলক প্রচেষ্টা শুরু করে । তারপর ফের একবার মুঘল সম্রাট বাবর খবরে এসেছেন। ‘দ্য এম্পায়ার’ গণহত্যাকারী পাগলের একটি অত্যন্ত গোলাপী প্রতিকৃতি উপস্থাপন করে, যিনি তার আদর্শকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য গণহত্যা চালিয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন। যদিও হটস্টার দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিল যে ‘দ্য এম্পায়ার’ গণহত্যাকারী অত্যাচারীর ইতিহাসকে সাদা করে তুলেছে। বাবরেরও বেশ অপ্রচলিত যৌন প্রবণতা ছিল , যা অত্যন্ত সমস্যাযুক্ত এবং প্রায়শই সীমা অতিক্রম করত।
বাবরের সমাধি আফগানিস্তানের কাবুলের বাবরের উদ্যানে অবস্থিত। ১৯৯২-৯৬ সালের মধ্যে আফগান গৃহযুদ্ধে এটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং আফগান মন্ত্রণালয় কর্তৃক সংস্কারের প্রচেষ্টা শুরু হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাবর প্রীতি তে অনুপ্রাণিত হয়ে আফগানিস্তানের শাসক মহম্মদ জাফর শা- বাবরের কবর নতুন করে সাজিয়ে তুলতে উদ্যোগী হন । নটবর সিং , তাঁর লেখা বই “ওয়ান লাইফ ইজ নট এনাফ”-এ ইন্দিরা গান্ধীর কাবুল সফর, বাবরের কবর দর্শন বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। উনি লিখেছেন বাবরের কবরের জন্য ইন্দিরা গান্ধী মোটা অঙ্কের অর্থ মঞ্জুর করেছিলেন । কিন্তু নেহেরুর বংশধরদের সঙ্গে হানাদার বাবরের কি কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল ? ভারতের হিন্দুদের কাছে কোনো কিছু কি গোপন করে যাচ্ছে কংগ্রেসের চালিকাশক্তি ওই পরিবারটি ? এই প্রশ্ন এখনো অমিমাংসিত আছে । হয়ত কালের নিয়মে একদিন তা প্রকাশ্যে আসবে ।।

