বাংলার রাজনীতিতে জ্যোতি বসু একটি উল্লেখযোগ্য নাম । বাংলাদেশি বংশভূত এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থাকে প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন ৷ একারণে তার দল তাকে “মহান কমরেড” উপাধিতে ভূষিত করে । এমনকি শোনা যায় যে দলীয় নেতার সম্মানে কলকাতার সল্ট লেক-কে “জ্যোতি বসু নগরী” করারও পরিকল্পনা করেছিল সিপিএম । কিন্তু ২০১১ সালে মমতা ব্যানার্জি সিপিএমের “বিদায় ঘন্টা” বাজিয়ে দেওয়ায় সেটা আর সম্ভব হয়নি ।
এরাজ্যে দীর্ঘ ৩৪ বছর বামফ্রন্ট্রের শাসনকালের সিংহভাগ সময়েই মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু । প্রায় আড়াই দশক মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় আইনশৃংখলার অববতি,শিল্পায়ন ধ্বংস করা,রাজ্য জুড়ে সন্ত্রাসের আবহ কায়েম করে রাখার মত গুরুতর সব অভিযোগ ওঠে । সেসময় একাধিক নরসংহারের ঘটনা ঘটে এরাজ্যে । নিজে বাংলাদেশি বংশভূত হয়েও মারিচঝাঁপিতে বাংলাদেশি নমঃশুদ্রদের পরিকল্পিত নরসংহার চালানোর অভিযোগ ওঠে জ্যোতি বসুর বিরুদ্ধে । এছাড়া তার সময়েই বিজন সেতুতে আনন্দমার্গী সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসীনিদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটেছিল, যার ন্যায়বিচার আজও হয়নি । বর্ধমানের সাঁইবাড়ির নরসংহারের ঘটনার সময়েও মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু । সেই নৃশংস বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের ন্যায় বিচার আজও পায়নি নিহতদের পরিবার । সাঁইবাড়ির হত্যাকাণ্ডের মূল অভিযুক্ত নিরুপম সেন তৎকালীন বামফ্রন্ট ক্যাবিনেটের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন । জ্যোতি বসুর কল্যানে তাকে তিনি বহাল তবিয়তে ছিলেন । শুধু তাইই নয়,শ্রমিক আন্দোলনের নামে একাধিক শিল্পাঞ্চলকে ধ্বংস করার অভিযোগ ওঠে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে । তার মধ্যে অন্যতম হল বেঙ্গল কেমিক্যালস, অশোক পেপার মিলস, ইস্টার্ন লজ, এবং ন্যাশনাল টোব্যাকো ।
আরও এক বাঙালি শিল্পপতির সর্বনাশ করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল জ্যোতি বসুর বিরুদ্ধে । কারন তিনি তিনি নাকি জ্যোতি বসুর হয়ে নির্বাচনী প্রচার করতে অস্বীকার করেছিলেন । আর সেই হতভাগ্য বাঙালি শিল্পপতি হলেন সাঁতারু মিহির সেন, একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন সাঁতারু । এই প্রতিবেদন সেই মিহির সেনকে নিয়েই ।
হ্যাঁ, এই সেই মিহির সেন যিনি ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে প্রথম ভারতীয় সাঁতারু হয়েছিলেন। ১৯৫৮ সালে ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়ার পর, মিহির সেন ভারত সরকারের সহায়তায় আরও সাতটি সমুদ্র সাঁতার কেটে তার অসাধারণ দক্ষতা এবং ধৈর্যের প্রমাণ দেন। ফলস্বরূপ, তিনি ১৯৫৯ সালে পদ্মশ্রী এবং ১৯৬৭ সালে পদ্মভূষণে ভূষিত হন। এমনকি তাঁর কৃতিত্বের জন্য তিনি তাঁর ব্যতিক্রমী কৃতিত্বের জন্য ব্লিটজ নেহেরু ট্রফিও অর্জন করেন।
মানুষ প্রায়শই বলে যে বাঙালিরা ব্যবসা করতে জানে না — কিন্তু মিহির সেন অন্য ধাতুতে গড়া বাঙালি । এটক তিনি নিজের কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণও করেছেন । তিনি রেশম রপ্তানিতে উদ্যোগী হন এবং শীঘ্রই, তার গুণমান এবং সততার জন্য তার কোম্পানি ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম রেশম রপ্তানিকারক হয়ে ওঠে, যা সরকার কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতও হয় । কিন্তু ভাগ্য – অথবা বলা চলে যে বামপন্থীদের অন্য পরিকল্পনা ছিল।
বছরটি ছিল ১৯৭৭, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন ঘনিয়ে আসছিল। সেই সময় মিহির সেনকে জ্যোতি বসুর পক্ষে প্রচারণা চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। অনুরোধের সাথে সাথে একটি সরকারি পদের লোভও এসেছিল তার কাছে । কিন্তু আদ্যপ্রান্ত সৎ মানুষ মিহির সেন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন — এবং পরিবর্তে, পরের দিনই তিনি একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দাখিল করেছিলেন।।সেই নির্বাচনে জ্যোতি বসু বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন এবং মুখ্যমন্ত্রী হন। কিন্তু তিনি মিহির সেনের অবাধ্যতা ভোলেননি । এরপর যা ঘটেছিল তা ছিল নিছক প্রতিশোধ।
জ্যোতি বসু তার “হার্মাদ বাহিনী” কে মিহির সেনের দিকে লেলিয়ে দেন । ধর্মঘট, হুমকি এবং বিশৃঙ্খলা নিয়মিত হয়ে ওঠে। মিহির সেন ট্রেড ইউনিয়নের দাবির কাছে মাথা নত করতে অস্বীকৃতি জানালে, তার অফিস, দোকান এবং কারখানাগুলি গ্রাফিতি এবং স্লোগানে ঢাকা পড়ে যায়। সিপিএমের ট্রেড ইউনিয়ন “সিআইটিইউ” -এর কর্তৃক দিনব্যাপী অবরোধের ফলে তার ব্যবসা অচল হয়ে পড়ে।
অশান্তি শীঘ্রই কিদ্দারপুরে তার রেশম কারখানাগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে । ফলশ্রুতিতে একসময়ের সমৃদ্ধ কারখানাগুলি রাতারাতি ভুতুড়ে ঘরে পরিণত হয়েছিল। টেক্সটাইল ওয়ার্কশপগুলি দখল হয়ে যায় । আলিমুদ্দিন স্ট্রিট (সিপিএমের সদর দপ্তর) থেকে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তাই পুলিশ নীরব দর্শক হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু তখনও মিহির সেন হাল ছাড়েননি । শেষ পর্যন্ত সিআইটিইউ কর্মীরা লক্ষ লক্ষ টাকার রপ্তানি পণ্য বোঝাই ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশ নির্বাক দর্শক হয়ে দাঁড়িয়েছিল – তারা থামানোর চেষ্টাও করেনি।
বছরের পর বছর ধরে চলা ইউনিয়ন হিংসা মিহির সেনের একসময়ের সমৃদ্ধ ব্যবসা ধ্বংস করে দেয়।
এখানেই শেষ হয়নি জ্যোতি বসুর প্রতিহিংসা পরায়নতা । এরপর আসে মিথ্যা মামলা।।পুলিশ মিহির সেনের বাড়ি, তার কোম্পানি, তার কারখানা – সর্বত্র অভিযান চালায়। তার নগদ টাকা, সম্পদ এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়, যার ফলে তার পরিবার ভেঙে পড়ে এবং নিঃস্ব হয়ে পড়ে। এমন একটা সময় আসে যে যিনি একসময় ভারতকে নিজের শিল্পের জন্য গর্বিত করেছিলেন, তিনি তার পরিবারের জন্য খাবার জোগাড় পর্যন্ত করতে পারতেন না।এরপরই, মিহির সেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন এবং স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন,তখন তাঁর বয়স মাত্র ৫০ বছর ।
সেইসব মিথ্যা মামলার জন্য তাকে নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে হত। আদালত কক্ষে বামপন্থী আইনজীবীরা তাকে এবং তার স্ত্রীকে উপহাস এবং অপমান করতেন। তবুও,প্রতিহিংসা পরায়ন জ্যোতি বসুর আক্রোশ প্রশমিত হয়নি । ১৯৮৮ সালে, জ্যোতি বসু ভেঙে পড়া মানুষটিকে আবার ডেকে পাঠান এবং তাকে বামফ্রন্টে যোগদানের সুযোগ দেন। মিহির সেন সরাসরি তা প্রত্যাখ্যান করেন। প্রতিশোধ হিসেবে, বামপন্থী দুষ্কৃতীরা তার জীবনকে আরও অসহনীয় করে তোলে। ১৯৯৭ সালে মিহির সেন মারা যাওয়ার সময়, তিনি সম্পূর্ণরূপে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন। আলিপুরে এলআইসি কর্তৃক বরাদ্দকৃত একটি ছোট ফ্ল্যাট ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।
আপনারা হয়তো ভাববেন যে মৃত্যুর সাথে সাথে তার কষ্টের অবসান হয়েছে — কিন্তু না, পরেও তা অব্যাহত ছিল।লন্ডনে বসবাসকারী তার মেয়ে সুপ্রিয়া কয়েক বছর পর ফিরে এসে দেখেন আলিপুরের ফ্ল্যাট লুটপাট করা হয়েছে। মিহির সেনের পদ্মশ্রী এবং পদ্মভূষণ পদক সহ আরও বেশ কিছু পুরস্কার চুরি হয়ে গেছে। এমনকি ফ্ল্যাট খালি করার জন্য তাকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় থানা এবং কলকাতা পুলিশ কমিশনারের কাছে অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও, কিছুই হয়নি।এভাবে, এই বিশ্বখ্যাত বাঙালি সাঁতারু, যিনি একসময় ভারতের গৌরব বয়ে এনেছিলেন, জনসাধারণের স্মৃতি থেকে মুছে গেলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে ধ্বংস হয়ে গেলেন।
আধুনিক প্রজন্ম এই ইতিহাস সম্পর্কে অবগত নয় । তাদের জানা উচিত যে নিজের রাজ্যেরই এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যাকে আজও অল্প হলেও কিছু সংখ্যক মানুষ আদর্শ হিসাবে মানে,তার প্রকৃত স্বরূপ কেমন ছিল। মিহির সেনের কৃতিত্বের কথা তারা হয়তো পাঠ্যপুস্তকে পড়ে থাকবে, কিন্তু জ্যোতি বসুর অহংকার এবং নিষ্ঠুরতার দ্বারা ধাপে ধাপে একজন সফল ক্রীড়াবিদ এবং উদ্যোক্তা কীভাবে ধ্বংস ও অপমানিত হয়েছিলেন তা হয়তো তারা শোনেনি।।

