এইদিন ওয়েবডেস্ক,কলকাতা,১৮ অক্টোবর : গতকাল থেকে রাজ্যের ১ লক্ষ ৫ হাজার অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও ৭২ হাজার আশা কর্মীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে স্মার্টফোন কেনার জন্য ১০,০০০/- টাকা করে টাকা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি । এই কারনে তিনি “সকল অঙ্গনওয়াড়ি ও আশা কর্মীকে জানাই উষ্ণ অভিনন্দন এবং তাঁদের পরিবারের সকল সদস্যকে আমার আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা”ও জানিয়েছিলেন । কিন্তু স্মার্টফোনের ১০,০০০/- টাকা করে পেতে প্রতিটি অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীকে সংশ্লিষ্ট বিডিও অফিসে গিয়ে মুচলেকায় স্বাক্ষর করে আসতে হচ্ছে৷ সেই মুচলেকায় যে যে শর্তের কথা বলা হয়েছে তা শুনলে চমকে যাবেন ৷
স্মার্টফোন দেওয়ার প্রসঙ্গে মমতা ব্যানার্জি গতকাল ফেসবুকে লিখেছিলেন,”আমি সবসময় বিশ্বাস করি, আমাদের অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও আশা কর্মীরা আমাদের শিশুদের পুষ্টি, মায়েদের স্বাস্থ্য, প্রসূতিদের দেখভালের ক্ষেত্রে নানান গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। আমি মনে করি, আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস তাঁদের সেই পরিশ্রমেরই স্বীকৃতি। আশা করি, রাজ্য সরকারের এই পদক্ষেপ তাঁদের প্রতিদিনের কর্মযজ্ঞে নতুন উদ্দীপনা যোগাবে এবং শিশু ও মাতৃকল্যাণে আরও অগ্রগতি আনবে।”
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী স্মার্টফোন নিয়ে গালভরা কথা বললেও ফোনের মালিকানা অধিকার অঙ্গনওয়াড়ি ও আশা কর্মীদের থাকবে না । আসল মালিক হবে রাজ্য সরকারের শিশু উন্নয়ন অফিস প্রকল্প কর্মকর্তা । অর্থাৎ স্মার্টফোনগুলির কার্যত “কেয়ারটেকার”- এর ভুমিকা পালন করতে হবে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও আশা কর্মীদের । ফোন চুরি গেলে বা কোনো ক্ষতি হলে স্বল্পবেতনের ওই সমস্ত অস্থায়ী নারীকর্মীদের দায় নিতে হবে৷ এমনকি কোনো প্রকার ক্ষতির জন্য তার মূল্য অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও আশা কর্মীদের আসাম্মানিক থেকে কেটে নেওয়া হবে ৷ অবসর গ্রহনের পর ফোন ফেরত দিতে হবে অফিসকে । ফলে রাজ্য সরকারের দেওয়া ১০ হাজারি স্মার্টফোন কার্যত গলার কাঁটা হয়ে গেছে ওই সমস্ত হতদরিদ্র মহিলাদের জন্য ।
দপ্তর সূত্রে খবর, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও আশা কর্মীদের ১০ হাজারি ফোনের জন্য বিডিও অফিস থেকে যে মুচলেকায় স্বাক্ষর করে নেওয়া হচ্ছে তাতে স্মার্টফোনের বিবরণ ও শর্তাবলির কথা উল্লেখ করা হয়েছে । জেলা শিশু উন্নয়ন অফিস প্রকল্প কর্মকর্তার স্বাক্ষরিত ওই মুচলেকার বিষয়বস্তু হল : “স্মার্টফোন কেনার জন্য টাকার বরাদ্দকরণ” । তাতে বলা হয়েছে,’সুসংহত শিশু বিকাশ সেবা প্রকল্পের সমস্ত অঙ্গনওয়াড়ী কর্মীদের জানানো হচ্ছে যে তাদের প্রত্যেকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে আগামী তিনদিনের মধ্যে ১০০০০/- (দশহাজার) টাকা একটা স্মার্টফোন ও আনুষঙ্গিক সামগ্রী কেনার জন্য দেওয়া হচ্ছে। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা দেওয়ার ১ মাসের মধ্যে স্মার্টফোন ও আনুষঙ্গিক সামগ্রী কেনার কাজ সম্পন্ন করতে হবে।’
বলা হয়েছে,’যদি কোন অঙ্গনওয়াড়ী কর্মীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে দেওয়া ১০০০০/ টাকার কম দামে স্মার্টফোন ও আনুষঙ্গিক সামগ্রী কেনেন, তাহলে সেই উদ্বৃত্ত অর্থ আগামীদিনে অফিস থেকে তাদের প্রাপ্য টাকা থেকে কেটে নেওয়া হবে। ভারত সরকারের মহিলা ও শিশু বিকাশ মন্ত্রকের স্মারক সংখ্যা PA/293/2022-CPMU তারিখ 28/03/2023 -তে উল্লিখিত নূন্যতম স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী স্মার্টফোন ও আনুষঙ্গিক সামগ্রী কিনতে হবে। স্মার্টফোন ও আনুষঙ্গিক সামগ্রীর নূন্যতম স্পেসিফিকেশন নীচে দেওয়া হল:
★ স্মার্টফোনটি হতে হবে লেটেস্ট অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের ।
★ স্ক্রীন সাইজ হবে ৬ ইঞ্চি বা তার অধিক ।
★ ডিভাইস র্যাম(আর এ এম) ৪ জিবি বা তার অধিক
★ ইন্টারন্যাল স্টোরেজ এন্ড প্রফেসর (আর ও এম) হতে হবে ৬৪ জিবি বা তার বেশি ।
★ ব্যাটারি হতে হবে নুন্যতম ৪৮০০ এমএইচএ । যাতে সারাদিন সার্ভিস দিতে সক্ষম ।
★ কানেকটিভিটি হতে হবে ২-জি,৩-জি,৪-জি, ওয়াইফাই এবং এমনকি ৫-জি ।
★ ইংরাজি এবং যেকোনো ভারতীয় ভাষার ইউনিকোড সমর্থনযোগ্য হতে হবে৷
বলা হয়েছে, প্রত্যেক অঙ্গনওয়াড়ীকে, স্মার্টফোন ও আনুষঙ্গিক সামগ্রী কেনার এক সপ্তাহের মধ্যে, কেনা সামগ্রী ও তার বিল এবং একটি অঙ্গীকারপত্র সহ প্রকল্প অফিসে উপস্থিত হতে হবে। অঙ্গীকারপত্রের বয়ান হল :
বিল-এ বিল নম্বর/GSTIN সহ নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর উল্লেখ থাকবে:
(১) স্মার্টফোন ও আনুষঙ্গিক সামগ্রীর দাম আলাদা ভাবে লেখা থাকতে হবে।
(২) স্মার্টফোনের মডেল ও আইএমইআই (Intemational Mobile Equipment Identity) নম্বর উল্লেখ করা থাকবে ।
(৩) বিল অবশ্যই অঙ্গনওয়াড়ী কর্মীর নামে হতে হবে ও কেনার তারিখ এই চিঠি ইস্যু করার তারিখ, অর্থাৎ,… বা তার পরের যে কোন অরিখ হতে হবে ।
(৪) বিল-এ বিক্রেতার স্বাক্ষর স্পষ্টভাবে থাকতে হবে।
অঙ্গীকারপত্রে বলা হয়েছে,স্মার্টফোন ও আনুষঙ্গিক সামগ্রী প্রকল্প অফিসে প্রথম পর্যায়ে প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা করে দেখা হবে ও পরবর্তীকালে দ্বিতীয় পর্যায়ে অন্য এক টেকনিক্যাল টীম পরীক্ষা করে দেখবে। এই দ্বিস্তরীয় পরীক্ষার যে কোন পর্যায়ে যদি দেখা যায় যে স্মার্টফোন কেনা হয়েছে তার স্পেসিফিকেশন পূর্বে উল্লেখিত নূন্যতম স্পেসিফিকেশনের থেকে কম তাহলে ঐ স্মার্টফোন বদল করে নূন্যতম স্পেসিফিকেশন আছে এই রকম স্মার্টফোন নিতে হবে, অন্যথায় ঐ অঙ্গনওয়াড়ী কর্মী ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে দেওয়া ১০০০০/- টাকা আগামীদিনে অফিস থেকে তার প্রাপ্য টাকা থেকে কেটে নেওয়া হবে। এই স্মার্টফোন কেবলমাত্র পোষণ অভিযানের বিভিন্ন তথ্য আপলোড করা ও অফিস সংক্রান্ত কাজে ব্যবহার করা যাবে।
অঙ্গনওয়াড়ী ও আশা কর্মীদের যে মুচলেকায় স্বাক্ষর করা হচ্ছে তাতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে :
(৪) আমি অবগত আছি যে এই স্মার্টফোন ও আনুষঙ্গিক সামগ্রী সম্পূর্ণভাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নারী ও শিশুবিকাশ এবং সমাজকল্যাণ দপ্তরের সম্পত্তি ও কেবলমাত্র পোষণ অভিযানের বিভিন্ন তথ্য আপলোড করা ও অঙ্গনওয়াড়ী-আশা কর্মী হিসাবে অফিস সংক্রান্ত অন্যান্য কাজেই ব্যবহার করা যাবে।
(৫) অঙ্গনওয়াড়ী ও আশা কর্মী হিসাবে এই স্মার্টফোন ও আনুষঙ্গিক সামগ্রী যতদিন আমার কাছে থাকবে ও ব্যবহৃত হবে, ততদিন এই সকল সামগ্রীর সুরক্ষা, রক্ষণাবেক্ষণ ও সঠিক ব্যবহারের দ্বায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে আমার।
(৬) আমার ব্যবহারকালীন সময়ে যদি এই স্মার্টফোন ও আনুষঙ্গিক সামগ্রী হারিয়ে যায়, চুরি হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা আমার গাফিলতির কারণে অপব্যবহার হয়, তাহলে তার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, যা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ স্থির করবেন, দিতে আমি বাধ্য থাকব।
(৭) আমি পদত্যাগ করলে, বরখাস্ত হলে, অন্য প্রকল্পে বদলী হলে বা অবসর গ্রহণের সময় (আকস্মিক প্রয়াণে উত্তরাধিকারী কর্তৃক) এই স্মার্টফোন ও আনুষঙ্গিক সামগ্রী প্রকল্প অফিসে ফেরৎ দিতে বাধ্য থাকব।
(৮) আমি উপরে উল্লিখিত সমস্ত নিয়ম মেনে চলব ও উপরিউক্ত নিয়মের কোন লঙ্ঘন হলে আমার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
এখন প্রশ্ন হল যে ৪-জিবি আরএএম, ৬৪-জিবি আরওএম, ৬ ইঞ্চি স্ক্রীন ও ৪৮০০ এমএইচএ ব্যাটারি সুবিধা যুক্ত কোনো নামি কোম্পানির স্মার্টফোন কি ১০,০০০ টাকায় পাওয়া আদপেই কি সম্ভব ? যদি পাওয়াও যায়, ফোনটির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে শর্ত আরোপ করা হয়েছে তা কি কর্মব্যস্ততার মধ্যে পালন করতে পারবেন অঙ্গনওয়াড়ী ও আশা কর্মীরা ? কর্মক্ষেত্রে ‘সরকারি ফোন’টি সুরক্ষিত রাখতে সর্বদা যে চাপের মধ্যে থাকতে হবে অঙ্গনওয়াড়ি ও আশা কর্মীদের তাতে তাদের কাজকে কি প্রভাবিত করবে না? তাদের কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন যে এমন ফোন দেওয়ার থেকে না দেওয়াই ভালো ছিল।।

