Mahanavami 2025 : আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে মহা নবমী পালিত হয়। আজ বুধবার মহানবমী ৷ দুর্গাপূজার সমাপ্তি লগ্নের দিন, যখন দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেন। আজ মাতা দুর্গার নবম শক্তি ‘সিদ্ধিদাত্রী’র পূজা করা হয় । এই দিনের পূজার মূল আকর্ষণ হলো সন্ধিপূজা, যা মহাঅষ্টমী ও মহানবমীর সংযোগকালে অর্থাৎ অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট এবং নবমী তিথির প্রথম ২৪ মিনিট ধরে চলে। এই সময়েই দেবী চণ্ডিকা চামুণ্ডা রূপে মহিষাসুরকে বধ করেন এবং এর প্রতীকস্বরূপ ১০৮টি পদ্ম ও ১০৮টি মাটির প্রদীপ নিবেদন করা হয়। এর পর শুরু হয় মূল মহানবমীর পূজা, যেখানে দেবীর আরাধনা করা হয় এবং বিভিন্ন আচার পালন করা হয়। কিছু অঞ্চলে এই দিনে কুমারী পূজা করা হয়।
এই দিনে দেবী দুর্গার অপরাজিতা রূপে পূজা করা হয়। এরপর মহা আরতি হয় যা দুর্গাপূজার গুরুত্বপূর্ণ আচার-অনুষ্ঠান এবং প্রার্থনার সমাপ্তি নির্দেশ করে। নবমী ভোগ নামে পরিচিত এই দিনে একটি প্রধান ভোগ হয় – দেবী দুর্গার প্রিয় খাবার তাঁকে উৎসর্গ করা হয়। এরপর এটি প্রসাদ হিসেবে বিতরণ করা হয়।
মহানবমী ও বিজয়া দশমীর পূজার নির্ঘন্ট
বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা অনুসারে ১৪ আশ্বিন, বুধবার (১ অক্টোবর) সন্ধ্যা ৭টা ২ মিনিট পর্যন্ত নবমী তিথি। সকাল ৯টা ২৮ মিনিটের মধ্যে নবমী বিহিত পুজো। কুমারী পুজো, বলিদান ও হোমকর্ম হবে সকাল ১০টা ১৫ মিনিট থেকে দুপুর ১২টা ২৯ মিনিটের মধ্যে। ১৫ আশ্বিন, বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর) সন্ধ্যা ৭টা ১১ মিনিট পর্যন্ত দশমী তিথি। সকাল ৯টা ২৮ মিনিটের মধ্যে দশমী বিহিত পুজো ও বিসর্জন প্রশস্ত।
গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা মতে ১ অক্টোবর (১৪ আশ্বিন) দুপুর ২টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত নবমী থাকবে। সকাল ৯টা ২৭ মিনিটের মধ্যে নবমী বিহিত পুজো সম্পন্ন করতে হবে। দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটের মধ্যেই কুমারী পুজো, বলিদান ও দেবীর নবরাত্রি ব্রত সমাপন হবে। ২ অক্টোবর (১৫ আশ্বিন) দুপুর ২টা ৫৪ মিনিট পর্যন্ত দশমী তিথি চলবে।
দেবী সিদ্ধিদাত্রী
নবরাত্রির নবম দিনে পূজিত হন দেবী দুর্গার সিদ্ধিদাত্রী রূপ। দেবীর আশীর্বাদে দাম্পত্য কলহ থেকে দুঃখ, কষ্ট মুক্তি পেতে নবমীর দিন এই আচার পালন করুন :
★এই দিনে দেবীকে ৮টি পদ্মফুল অর্পণ করুন। কেবল পদ্ম নয়, এ দিন অবশ্যই দেবীকে অপরাজিতা ফুলও দেবেন। অর্পণ করুন ১০৮টি বেল পাতা।
★দেবীকে দিন লাল রঙের ওড়না, মাখানা, বাতাসা। সঙ্গে দিন কিছু কয়েন। এতে দেবী তুষ্ট হন। দূর হয় দুঃখ, কষ্ট।
★নবমীর দিন বাড়ির অগ্নি কোণে দেবীর নামে একটি প্রদীপ জ্বালান। সন্ধ্যাবেলায় অবশ্যই দেবীর আরতি করুন।
★অর্থা দূর করতে এই দিন দেবী দুর্গাকে গঙ্গাজল দিয়ে স্নান করান। পাঠ করুন দুর্গা রক্ষাকবচ। নবমীর দিন দেবী দুর্গার সামনে কর্পূরের আরতি করুন। একই সঙ্গে এদিন দুর্গাস্তোত্র পাঠ করা শুভ বলে মনে করা হয়।
★ তবে নবমীর দিন ভুলেও কালো রঙের পোশাক পরবেন না,বরং বেগুনি রঙের পোশাক পরুন। দাম্পত্য কলহ এড়াতে নবমীর দিন লাউ খাবেন না ।
★ নবমীর দিনে হোমের ছাই একটু বাড়ি এনে ঘরের যে কোনও পবিত্র স্থানে রেখে দিন। এতে বাস্তুদোষ কেটে যায়।
★এই বিশেষ দিনটিতে পাঁচটি গোলাপের পাপড়ির দু’দিকে মধু মাখিয়ে দেবীর কাছে রেখে আসুন। এটি খুন শুভ বলে মনে করা হয় ।
★নবমীর দিন ৯ জন কুমারীকে বাড়িতে বসে ভোজ খাওয়ানো অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়।
দেবী সিদ্ধিদাত্রী পুজা মন্ত্র :
ধ্যান মন্ত্র:
সিদ্ধগন্ধর্বযক্ষাদ্যৈরসুরৈরমরৈরপি।
সেব্যমানা সদা ভূয়াৎ সিদ্ধিদা সিদ্ধিদায়িনী।।
জপের উপকারিতা
★ রহস্যময় ক্ষমতা এবং অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে ।
★ মানসিক বাধা এবং অহংকার দূর করে।
★ আধ্যাত্মিক চেতনা বৃদ্ধি করে ।
প্রধান মন্ত্র :
“ॐ देवी सिद्धिदात्र्यै नमः”
এই মন্ত্রটি ঐশ্বরিক জ্ঞান, পরিপূর্ণতা এবং আধ্যাত্মিক উপহারের আহ্বান জানায়।
দেবী সিদ্ধিদাত্রী অসম্ভব কে সম্ভব করেন, যেকোনো মনস্কামনা পূর্ণ করেন । দেবী সর্বপ্রকার সিদ্ধি প্রদান করে থাকেন। মার্কণ্ডেয়পুরাণ অনুসারে অণিমা, মহিমা, গরিমা, লঘিমা, প্রাপ্তি, প্রাকাম্য, ঈশিত্ব এবং বাশিত্ব—এই আট প্রকারের সিদ্ধি হয়ে থাকে। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডে এর সংখ্যা আঠারো বলে উল্লিখিত আছে। যথা- (১) অণিমা (২) লঘিমা (৩) প্রাপ্তি (৪) প্রাকাম্য (৫) মহিমা (৬) ঈশিত্ব, বাশিত্ব (৭) সর্বকামাবসায়িতা (৮) সর্বজ্ঞত্ব (৯) দূরশ্রবণ (১০) পরকায়প্রবেশন (১১) বাকসিদ্ধি (১২) কল্পবৃক্ষত্ব (১৩) সৃষ্টি (১৪) সংহারকরণসামর্থ্য (১৫) অমরত্ব (১৬) সর্বন্যায়কত্ব (১৭) ভাবনা এবং (১৮) সিদ্ধি।
মাতা সিদ্ধিদাত্রী ভক্ত ও সাধকদের এই সব সিদ্ধি প্রদান করতে সমর্থা। দেবীপুরাণ অনুসারে ভগবান শিব এঁরই কৃপায় সকল সিদ্ধি প্রাপ্ত হন। এঁর অনুকম্পাতেই ভগবান শিবের অর্ধেক শরীর দেবীর হয়েছিল। সেজন্যই তিনি জগতে ‘অর্ধনারীশ্বর’ নামে প্রসিদ্ধ। মাতা সিদ্ধিদাত্রী চতুর্ভুজা। ইনি কখনও সিংহবাহনা, কখনও পদ্মাসনা। এঁর দক্ষিণের নিম্নস্থিত হস্তে চক্র, উপরি হস্তে গদা, বামের নিম্নস্থিত হস্তে শঙ্খ এবং উপরিস্থিত হস্তে পদ্মফুল। নবরাত্রি পূজার নবম দিনে এঁর আরাধনা করা হয়। এইদিন শাস্ত্রীয় বিধি-নিয়ম অনুসারে এবং পূর্ণ নিষ্ঠা নিয়ে যিনি সাধনা করেন তাঁরা সকল সিদ্ধি প্রাপ্ত হন। জগতে তার আর কোন কিছুরই অগম্য থাকে না। ব্রহ্মাণ্ডে তার পূর্ণ বিজয় লাভ করার ক্ষমতা হয় ।
দেবী মা সিদ্ধিদাত্রী পূজা বিধান – আচার ও অর্ঘ নিবেদন
★তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠুন, স্নান করুন এবং বেগুনি বা হালকা বেগুনি রঙের পোশাক পরুন ।
★পদ্মফুল দিয়ে সজ্জিত একটি পরিষ্কার বেদীর উপর দেবীর মূর্তি বা ছবি স্থাপন করুন।
★ নারকেল, মিষ্টি, ধূপ এবং ফল উৎসর্গ করুন ।
★ একটি প্রদীপ জ্বালান, তার মন্ত্রগুলি জপ করুন এবং নবমী আরতি করুন।
★ কন্যা পূজা ও প্রসাদ বিতরণের মাধ্যমে সমাপ্তি ।দেবীর পছন্দের ভোগ (নৈবেদ্য)
তিল দিয়ে তৈরি মিষ্টি , হালুয়া এবং ফল শুভ বলে বিবেচিত হয়।
প্রত্যেক মানুষেরই কর্তব্য হল মা সিদ্ধিদাত্রী দেবীর কৃপা লাভ করার জন্য নিরন্তর চেষ্টা করা, তাঁর আরাধনায় এগিয়ে চলা। তাঁর কৃপায় অতীব দুঃখময় সংসারে নির্লিপ্ত থেকে সমস্ত সুখভোগ করে সাধক মোক্ষ লাভ করতে সক্ষম হয়।
নবদুর্গার মধ্যে মাতা সিদ্ধিদাত্রী হলেন অন্তিমরূপ। অন্যান্য অষ্টদুর্গার পূজা শাস্ত্র-বিধি অনুযায়ী করে ভক্ত দুর্গাপূজার নবম দিনে এঁর উপাসনায় প্রবৃত্ত হন। সিদ্ধিদাত্রী মাতার উপাসনা পূর্ণকরার পর ভক্ত ও সাধকদের লৌকিক-পারলৌকিক সর্বপ্রকার কামনা পূরণ হয়। কিন্তু সিদ্ধিদাত্রী মায়ের কৃপাপাত্র ভক্তের মধ্যে এমন কোন কামনা আর থাকে না, যা তিনি পূরণ করতে চান। তিনি সকল সাংসারিক ইচ্ছা, প্রয়োজন এবং স্পৃহার ঊর্ধ্বে উঠে মানসিকভাবে মা ভগবতীর দিব্যলোকে বিচরণ করেন। তাঁর কৃপার অমৃতধারা নিত্য পান করে তিনি বিষয় ভোগশূন্য হয়ে যান। মাতা ভগবতীর পরম সান্নিধ্যেই তাঁর পরম প্রাপ্তি হয়ে যায়। এই পরমপদ পাওয়ার পর তার আর কোন বস্তুর প্রয়োজন থাকে না।
মায়ের শ্রীচরণের সান্নিধ্য লাভের জন্য আমাদের সর্বদা নিয়মনিষ্ঠ থেকে তাঁর আরাধনা করা উচিত। মাতা ভগবতীর স্মরণ, পূজা-ধ্যান আমাদের এই জগতের অসারত্ব বোধ করায় এবং প্রকৃত পরম শান্তিদায়ক অমৃত পদের দিকে নিয়ে যায়।।