শ্যামসুন্দর ঘোষ,মন্তেশ্বর(পূর্ব বর্ধমান),০৪ সেপ্টেম্বর : বাদাই গানের আসর ঘিরে জমজমাট হয়ে উঠল পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর থানার পিপলন গ্রাম । এদিন শনিবার থেকে শুরু হয়েছে প্রাচীন এই লোকগানের অনুষ্ঠান । চলবে রবিবার পর্যন্ত । বাদাই গান শুনতে আশপাশের ৮-১০ টি গ্রাম থেকে প্রচুর মানুষ পিপলন গ্রামে ভিড় জমাচ্ছেন ।
প্রাচীন লোকগানগুলির মধ্যে অন্যতম বাদাই গান । শুরুতে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম কাহিনীর উপরেই ভিত্তি করেই বাদাই গান রচিত হত । গানের আসর বসত মূলত গ্রামের নাট মন্দিরে,বারোয়ারি তলায় বা কোনও সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়ির উঠনে সামিয়ানা টাঙিয়ে । বিভিন্ন সাজে সজ্জিত হয়ে অভিনয়ের ঢঙে গান গেয়ে গ্রাম প্রদক্ষিণ করতেন শিল্পীরা । থাকতো ঢোল,কাঁসি,বাঁশি,বাঁশরী, খঞ্জনি, নুপূর প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র । প্রথম দিকে কীর্তনের সুরে বাদাই গান গাওয়া হলেও পরবর্তী কালে টপ্পা, ঝুমুর, গাজনের সুরের অনুপ্রবেশ ঘটে । কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বাদাই গানের ভাষা ও সুরে লাগে আধুনিকতার ছোঁওয়া । গানের উপস্থাপনা একই থাকলেও ভাষায় ধর্মীয় কাহিনীর পাশাপাশি জায়গা নিতে শুরু করে লোকশিক্ষা,সমাজচিত্র ।
এক সময় বর্ধমান, হাওড়া প্রভৃতি জেলার গ্রামগুলিতে এই গানের খুব প্রসার ছিল । ধান রোয়া বা বোনার কাজ শেষ হলেই বাদাই গান শুরু হত । জন্মাষ্টমীর সময় থেকেই বাদাই গানের চর্চা চলতো । বিভিন্ন পালা,পার্বনে এই গানের চল ছিল । কিন্তু আজ গ্রাম বাংলা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে প্রাচীন এই লোকসংগীত । তবে ব্যতিক্রম শুধু পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর থানার পিপলন গ্রাম । অর্দ্ধ শতাব্দী ধরে বাদাই গানকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর এই সময়ে পিপলন গ্রামে উৎসব পালিত হয়ে আসছে । স্থানীয় রামকৃষ্ণ সংঘের উদ্যোগে এবারেও বাদাই গানের জমকালো আসর বসেছে গ্রামে ।
স্থানীয় গ্রামবাসী মানব ঘোষাল,সুমিত বৈরাগ্যরা বলেন, ‘প্রতি পাড়ায় ২-৩ টি করে দল তৈরি করা হয়েছে । এবারে গোটা গ্রাম জুড়ে মোট ৩০ টি দল রয়েছে । তাঁরা নিজেরাই গান রচনা করে সুর দিয়েছেন । প্রতিটি দল পৃথক পৃথক জায়গা থেকে সাজসজ্জা ও বাজনা ভাড়া করে এনেছেন ।’ তাঁরা বলেন, ‘এক সময়ে গ্রামের বিভিন্ন দলের মধ্যে প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা থাকতো । গানের মাধ্যমে একে অপকে কটাক্ষ করতেন । ফলে পরিস্থিতি এমন জায়গায় চলে যেত যে, গান বাজনা ছেড়ে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়তেন কলাকুশলী ও গ্রামবাসীরা । তবে এখন আর ওই সব ঝুটঝামেলা নেই ।’ পাশাপাশি তাঁরা জানান,আগের বারের তুলনায় এবারে অনেক অল্প বয়সী ছেলেরা অংশগ্রহন করেছেন । বিলুপ্ত প্রায় এই লোকগানকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এটা একটা ভালো লক্ষ্মণ বলে তাঁরা জানান ।
জানা গেছে,পিপলন গ্রামের প্রতি পাড়ার মাঝে চুন দিয়ে একটি করে বৃত্ত আঁকা হয়েছে । তার উপরে টাঙানো হয়েছে সামিয়ানা । দু’বেলায় ১৫ টি করে দল বেরুচ্ছে গ্রামে । বিভিন্ন সাজে সজ্জিত হয়ে পাড়ায় পাড়ায় টাঙানো সামিয়ানার নিচে গিয়ে বাজনার তালে নেচে নেচে বাদাই গান পরিবেশন করছেন শিল্পিরা । পুরুষরা স্ত্রীর সাজে সেজে নেচে নেচে গান গেয়ে গ্রামবাসীদের মনোরঞ্জন করছেন । এদিন সকাল থেকে পিপলন গ্রামে শুরু হয়েছে বাদাই গানের উৎসব । তবে বিকেল চারটে থেকে রাত্রি ৮ টা পর্যন্ত কার্যত উৎসব মুখর হয়ে ওঠে গোটা গ্রাম । পিপলন ছাড়াও আশপাশের করন্দা, খাতড়া, বামুনিয়া,কুলজোড়াসহ বেশ কিছু গ্রামের শতাধিক মানুষ বাদাই গানের উৎসব দেখতে পিপলন গ্রামে ভিড় জমান । তবে উৎসব করোনা বিধি মেনেই আয়োজন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা ।।
দেখুন ভিডিও :