প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,২০ সেপ্টেম্বর : পরিবারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। অভাবকে সঙ্গী করেই কাটে দিন। তবে তা নিয়ে শুধু আক্ষেপ করে বসে থাকতে চান নি পূর্ব বর্ধমানের মন্তেশ্বরের বাঘাসন গ্রামের মহিলারা।তাঁরা উপার্জনের দাগিদে কাঁধে তুলে নিয়েছেন ঢাক।হাতে তুলে নিয়েছেন ঢাক বাজানোর কাঠি। সময় গড়ানোর সাথে সাথে তাঁরা ভাল ঢাক বাজিয়ে হিসাবে সুনামও কুড়িয়ে নিয়েছেন। ঢাকের বাদ্যিতে এবছরও পুজো মণ্ডপ মাতাতে এই মহিলা ঢাকিরা এখন নিয়ম করে ঢাক বাজানোর মহড়া দিচ্ছেন। সেই মহড়া দেখে মনে হবে দু’হাতেই যেন ’দশভুজা’ এই মহিলারা।
মন্তেশ্বর ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রাম বাঘাসন ও মামুদপুর। এই গ্রাম গুলির বেশিরভাগ মানুষই কৃষিজীবী। বেঁচে থাকার রসদ জোগাড়ের জন্য বছর ৭-৮ আগে এই গ্রাম গুলির দরিদ্র পরিবারের বারো- পনের জন মহিলা প্রথম কাঁধে ঢাক তুলে নেন।তাঁদের কারুর স্বামী দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন,আবার কারুর স্বামী অসুস্থতার কারণে শয্যাশায়ী। এমন পরিস্থিতিতে এইসব মহিলাদেরকেই তাঁদের সংসারের যাবতীয় দায় কাঁধে তুলে নিতে হয়।কিন্তু সংসার চালানোর জন্য রোজগারের সন্মানজনক কোনও পথ তাঁরা খুঁজে পাচ্ছিলেন না।শেষমেষ তাঁরা ঢাক কাঁধে তুলে নিতে বাধ্য হন। দুর্গা মায়ের পুজোয় ঢাক বাজিয়ে তাঁরা যে উপার্জন করেন,তা দিয়ে একটু হলেও তাঁদের সংসারে সুখের দিন ফেরে বলে মহিলারা জানিয়েছেন।
বাঘাসনের মহিলা ঢাকি দলের সদস্য পূর্ণিমা দাস জানান,’ঢাক বাজিয়ে রোজগার করার সিদ্ধান্ত তাঁরা বছর সাত আগে নেন। তাঁদের উদ্দেশ্যের কথা জেনে এলাকার দুই প্রাজ্ঞ ঢাকি পিন্টু দাস ও সুদেব দাস তাঁদের প্রশিক্ষণ দেন।ওনাদের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েই তাঁরা ভালো ঢাক বাজানো রপ্ত করেন।এরপর গড়ে তোলেন ‘মা অন্নপূর্ণা’ নামে একটি মহিলা ঢাকিদল।দলীয় পোষাক হিসাবে তারা নির্ধারণ করেন লাল পাড় যুক্ত বাসন্তি রঙা শাড়ি এবং লাল রঙের ব্লাউজ।পূর্ণিমাদেবী জানান, তাঁদের ’মা অন্নপূর্ণা’ ঢাকির দলে যাঁরা রয়েছেন তাঁরা সবাই এখন ঢাক বাজিয়েই স্বনির্ভর হতে চাইছেন। তা দেখে অন্য গ্রামের মহিলাও আকৃষ্ট হন। এলাকার মামুদপুর গ্রামের মহিলারাও ঢাক বাজানোকে পেশ হিসাবে গ্রহন করে আলাদা ঢাকি দল তৈরি করেন।
‘মা অন্নপূর্ণা’ ঢাকি দলের অপর দুই সদস্যা নবানী দাস, রিঙ্কু দাস বলেন,বাঙালির সবথেকে বড় উৎসব দুর্গোৎসব।এই দুর্গোৎসব ছাড়াও কালী পুজো,সরস্বতী পুজো ও লক্ষ্মীপূজোতে আমরা ঢাক বাজাতে যাই।এছাড়াও ডাক পেলে অন্য পুজো পার্বণেও আমাদের ঢাকি দলের সদস্যরা ঢাক বাজাতে যান।বছরের বাকি দিনগুলিতে সংসারের অভাব মেটাতে তারা মাঠে খেতমজুরের কাজ করেন ।নবানী দাস বলেন, ’আমাদের মহিলা ঢাকি দলের সদস্যরা কলকাতা ও ব্যারাকপুর সহ ভিন জেলার বড় বড় পুজোয় ঢাক বাজিয়েছেন। পূর্বেকার বছর গুলোতে দূর্গা পুজোর চারটে দিন ঢাক বাজিয়ে ভালো উপার্জন হওয়ায় আমাদের মহিলা ঢাকি দলের সদস্যদের পরিবারের সকলের মূখে হাসি ফুটেছিল’।দুর্গা মায়ের কৃপায় এই বছরও ভাগ্য সহায় হবে বলে আশাবাদী ’মা অন্নপূর্ণা’ ঢাকি দলের সকল মহিলা সদস্যরা।
একই আশায় বুক বেধে আছেন,মামুদপুর গ্রামের মহিলা ঢাকিরা।এমন প্রত্যাশা তৈরি হবার কারণ কি? এর উত্তরে বাঘাসন ও মামুদপুর গ্রামের মহিলা ঢাকি পূর্ণিমা দাস,নবানী দাস ,টুসুমণি দাস ও পুষ্প দাস’রা
বলেন,বাংলার দুর্গা পুজোকে ’আবহমান ঐতিহ্যের’ স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। তারপর থেকে বাংলায়
দুর্গা পূজো এক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। রাজ্য সরকার পুজোর সরকারী অনুদানও অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন কলকাতা সহ রাজ্যের জেলায় জেলায় থিম ভাবনার বড় বাজেটের পুজো হচ্ছে। সেইসব পুজোয় এবছরও মন্তেশ্বরের বাঘাসন ও মামুদপুর গ্রামের মহিলা ঢাকি দলের অনেকে ঢাক বাজাবেন। তার বায়নাও হয়ে গিয়েছে। বাকি যাঁরা এখনও ডাক পায় নি তারাও মহালয়ার পর পরই নিশ্চই ডাক পেয়ে যাবেন।দুর্গা মায়ের কৃপায় এই বছরও পরিবারে মুখে হাসি ফোটাত পারবেন বলে প্রত্যাশী মন্তেশ্বরের মহিলা ঢাকিরা।।