এইদিন বিনোদন ডেস্ক,০২ সেপ্টেম্বর : মুসলিম লীগের নেতা হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট ডাইরেক্ট অ্যাকশান ডে বা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দেন । সেই সময় তিনি যুক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন । সোহ্রাওয়ার্দীর ঘোষণা মত এই দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। মুসলমানদের জন্য আলাদা বাসভূমি পাকিস্তানের দাবিতে এই দিন মুসলমানরা পশ্চিম বাংলার কলকাতা ও পূর্ব বাংলার নোয়াখালীতে হিন্দু নরসংহার চালায় । যেকারণে পশ্চিমবঙ্গে সোহ্রাওয়ার্দীকে “বাংলার কসাই” নামে অবহিত করা হয় । সেই নরসংহারের ইতিহাস তুলে ধরতে বহুভাষী ছবি ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস্’ তৈরি করেছেন প্রখ্যাত বলিউড পরিচালক বিবেক রঞ্জন অগ্নিহোত্রী (Vivek Ranjan Agnihotri) । কিন্তু গত ১৬ই আগস্ট কলকাতার বাইপাসের ধারে ওই বিলাসবহুল পাঁচ তারকা হোটেলে ট্রেলার লঞ্চ-এর আয়োজন করা হলে রাজ্যের শাসকদলের নির্দেশে পুলিশ সেই অনুষ্ঠান করতে দেয়নি বলে অভিযোগ । এদিকে আগামী ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে বিশ্বজুড়ে ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে রিলিজ হতে চলেছে । কিন্তু পরিচালক আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে পশ্চিমবঙ্গে ছবিটি নিষিদ্ধ করে দেওয়া হতে পারে । রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির উদ্দেশ্যে একটি ভিডিও বার্তায় তিনি ছবিটি বাংলায় রিলিজ করতে সহযোগীতা করার জন্য আবেদন জানিয়ে বলেছেন,’মুসলিম লীগের সদস্য ছাড়া কোন বাঙালি ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস্’ ব্যান করতেই পারে না৷’
ভিডিওতে পরিচালক বিবেক রঞ্জন অগ্নিহোত্রী মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির উদ্দেশ্যে বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি জি, এই ভিডিও আপনার জন্য । আমাদের ছবি “দ্য বেঙ্গল ফাইলস” গোটা বিশ্ব জুড়ে রিলিজ হতে চলেছে । কিন্তু অনেকে মনে করছেন যে পশ্চিমবঙ্গের ছবিটা হয়তো ব্যান করে দেওয়া হতে পারে । আমাকে প্রেক্ষাগৃহের মালিকরা বলছেন যে যদি ব্যান না করাও হয়, তাহলে রাজনৈতিক চাপ এতটাই থাকবে যে ছবিটা দেখাতে গেলে তাদের বহু মূল্য চোকাতে হতে পারে । এই কারণে তারা ছবিটা দেখাতে ভয় পাচ্ছেন । আর এই ভয়ের কারণেই তারা গত ১৬ ই আগস্ট আমাদের ট্রেলার দেখায়নি । আমরা যখন একটা বেসরকারি হোটেলেতে ট্রেলার দেখানোর ব্যবস্থা করেছিলাম তখন আপনার পুলিশ এসে কোন কারণবশতঃ বন্ধ করে দেয় ।’ তিনি মমতা ব্যানার্জির উদ্দেশ্যে বলেন,’আপনার দলের অনেক কর্মী ছবিটাতে ব্যান করে দেওয়ার দাবি তুলছে,যার পিছনে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণই নেই । এ কারণে আমি আপনার কাছে হাত জোড় করে অনুরোধ করব যে শান্তিপূর্ণভাবে ছবিটাকে পশ্চিমবঙ্গে রিলিজ হতে দিন । এবারে আমি কারণ বলছি ।’
তিনি বলেন,’প্রথমতঃ, আপনি ভারতের সংবিধানের শপথ নিয়েছেন । আর প্রতিটা ভারতীয় নাগরিকের বাক স্বাধীনতা সুরক্ষা দেওয়ারও হল শপথ নিয়েছেন আপনি৷ এই ছবিটা সিবিএফসি অনুমোদন করেছে, যেটা একটা সাংবিধানিক সংস্থা । এই কারণে এটা আমরা সাংবিধানিক কর্তব্য যে ছবিটাকে শান্তিপূর্ণভাবে রিলিজ করার দায়িত্ব আপনি নেবেন ।
দ্বিতীয়তঃ ভারত হল বিশ্বের সেই দেশ যা সর্বাধিক সময় ধরে প্রতারিত হয়েছে এবং পরাধীনতার (গুলামির) জীবন যাপন করেছে– শুধু ভূখণ্ডের নয়, নিজের আত্মা, সংস্কৃতি, ধর্মেরও । পুরো ১২০০ বছর ধরে আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ধর্ম, আমাদের পরিচয়, আমাদের সাহিত্য, আমাদের কলা, আমাদের ভাস্কর্যকে দন্ডিত ও খন্ডিত করা হয়েছে । আর তার মধ্যে সবথেকে যন্ত্রণাদায়ক ঘটনা হলো বাংলার “ডায়রেক্ট অ্যাকশন ডে” এবং “নোয়াখালী”-এর মত হিন্দু নরসংহারের ঘটনা । আর যদি তা না হত তাহলে হয়তো ভারতের বিভাজনও হত না । কিন্তু এগুলোকে আমাদের ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে । হয়তো গোপন করা হয়েছে ।’
বিবেক রঞ্জন অগ্নিহোত্রী বলেন,’কিন্তু বাংলা শুধু যন্ত্রণার নাম নয় । বাংলা হল সভ্যতার মুকুট । এটা এমন একটা প্রদেশ যেখানে নবজাগরণের সূচনা হয় । বিবেকানন্দ,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসরা তো বাংলা থেকেই এসেছেন । বাংলা ভারতকে জ্ঞান, কলা,ক্রান্তি এবং আত্মা দিয়েছে । জাতীয়তাবাদের ধারণাও দিয়েছে । কিন্তু এটাও সত্য যে বাংলা এমন একটা প্রদেশ যার দু’বার বিভাজন হয়েছে । ১৯০৫ সালে এবং ১৯৪৭ সালে৷ বাংলা যত বলিদান দিয়েছে, যত আহুতি দিয়েছে হয়তো অন্য কেউ দেয়নি । কিন্তু আজকের প্রজন্ম কি এ কথা জানে ?’
তিনি বলেন,’এখন আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করব : এমন কোনো খ্রিস্টান শিশু আছে যে ক্রস সম্পর্কে জানে না ? কোন কৃষ্ণাঙ্গ শিশু কি দাসত্ব প্রথাকে জানে না ? কোন জাপানি শিশু কি হিরোশিমা ও নাগাসাকির পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের কথা জানেনা ? তাহলে আপনি আমাকে বলুন যে কি কারনে আমাদের নতুন প্রজন্ম আমাদের সব থেকে যন্ত্রণাদায়ক চ্যাপ্টার কে জানে না ? বাংলার যন্ত্রনা বাংলার মানুষদের কষ্ট বলাটা কি অপরাধ? নতুন প্রজন্মের কাছে এই সত্য তুলে ধরা কি অপরাধ ? আপনি যদি রাজনৈতিক গণ্ডির বাইরে এসে একবার ভাবেন, একজন প্রকৃত ভারতীয়, একজন প্রকৃত বাঙালি হিসাবে যদি ভাবেন তাহলে এই ছবিকে আপনি ব্যান করবেন না বরঞ্চ স্যালুট করবেন ।’
দ্য বেঙ্গল ফাইলস-এর পরিচালক বলেন,’যখন মুসলিম, খৃষ্টান, দলিত মহিলাদের অত্যাচারের বিষয়ে ছবি তৈরি করা যেতে পারে তাহলে হিন্দুদের ইতিহাস, হিন্দুদের নরসংহারের কালো অধ্যায়ের উপরে ছবি কেন বানানো যাবে না ? আমার পুরো বিশ্বাস আছে যে ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে এবং নোয়াখালীর হিন্দু নরসংহার এর উপর নির্মিত ছবিকে কোনো বাঙালি ব্যান করতেই পারে না । অবশ্য সে যদি মুসলিম লীগের সদস্য না হয় তো ।’
তিনি বলেন,’এই ছবির বিশেষ কোন সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয় । এটা তাদের বিরুদ্ধে যারা মানবতার বিরুদ্ধে । যারা আজও মিথ্যাকে তারা জীবন্ত রাখতে চায় । আর যদি আপনি দ্য বেঙ্গল ফাইলসকে ব্যান করে দেন তাহলে হিন্দু নরসংহারের সেই সমস্ত পীড়িতদের আত্মা, যন্ত্রণা, কষ্টকেও আপনি নিষিদ্ধ করবেন ।’ পরিচালক বলেন,’যতক্ষণ না আমরা সত্যকে সামনে নিয়ে আসছি ততক্ষণ ক্ষত সারবে না, বরঞ্চ ভিতরে ভিতরে পচন ধরে যাবে এবং একদিন হাতের বাইরে চলে যাবে । আর এই কারণেই স্বাধীনতার ৭৮ বছর পরেও ভারত আজও সেই ভয়ঙ্কর রাজনীতির সঙ্গে লড়াই করছে, কারণ ভারতের বিভাজন হয়েছে । ক্ষত গোপন করলে ঘৃণা বাড়ে । দেখালেই টনক নড়ে । এই ছবি ঘৃণার নয়, সত্য ঘটনার উপর নির্মিত ।’
বিবেক অগ্নিহোত্রী বলেন,’বিগত দিনে আমেরিকায় বাঙালিরা এমন কি শিশুরা পর্যন্ত দ্য বেঙ্গল ফাইলস এর ট্রেলার দেখেছিল । তারা শুধু আমাকে একটা কথাই বলেছে যে আমাদের নতুন ধারণার সৃষ্টি হল । সেই কারণে আপনার কাছে আমার হাত জোড় করে অনুরোধ যে দয়া করে এই ছবিটাকে ব্যান করবেন না। এই ছবিটাকে দেখুন, উপলব্ধি করুন, এর উপর বিতর্ক করুন, কিন্তু সত্যকে ঢেকে রেখে দেবেন না । গোটা বিশ্বে হিন্দুদের একমাত্র রাষ্ট্র হল ভারত। তাহলে তারা কি নিজের ঘরেতেই নিজেদের যন্ত্রণা, ব্যাথার কথা বলতে পারবে না ?’
সবশেষে দ্য বেঙ্গল ফাইলসের পরিচালক বলেছেন, ‘বাংলার সত্য ভারতের সত্য । ডাইরেক্ট একশন ডে ও নোয়াখালীর কাহিনী যদি আমরা না বলি তাহলে কে বলবে ? এখন যদি না বলি তাহলে কখন বলব ? যদি সত্য ভীতিকর লাগে তাহলে আয়নাকে ভাঙা হয় না । আয়না ভেঙে দিলে চেহারা আর চেনা যায় না । তারপরেও যদি আপনার মনে হয় যে হিন্দুদের ইতিহাস, হিন্দুদের নরসংহারের কথা ভারতে বলা অপরাধ, তাহলে হ্যাঁ আমি অপরাধী । আপনি সরকার, আর আমি হলাম উই দ্য পিউপিলের মাত্র একটা নম্বর । আপনি যা খুশি আমাকে সাজা দিতে পারেন । বন্দে মাতরম ।’।