শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, মহাভারত, শ্রীহরিবংশসহ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রধানতম জীবনীগ্রন্থে শ্রীকৃষ্ণের জীবনের সাথে রাধানাম বা রাধা চরিত্রটি পাওয়া না গেলেও অন্যান্য বিবিধ পুরাণে রাধানাম বা চরিত্রটি রয়েছে। শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণের দশম স্কন্ধের ২৯-৩৩ এই পাঁচটি অধ্যায়কে ‘রাসপঞ্চাধ্যায়ী’ বলে। এই অধ্যাগুলোতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা বর্ণিত হয়েছে। তবে এই রাসলীলার মধ্যেও রাধানামটি পাওয়া যায় না-এই কথা যেমন সত্য, তেমনি সে রাসলীলার বর্ণনার মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাসমণ্ডল হতে হঠাৎ অন্তর্হিত হয়ে যান। তখন বিরহকাতরা গোপীগণ শ্রীকৃষ্ণের অনুসন্ধান করতে করতে বৃন্দাবনের অভ্যন্তরে ধ্বজবজ্রাঙ্কুশাদি-যুক্ত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পদচিহ্নের সাথে সাথে অন্য আরেকটি ব্রজবধূর পদচিহ্ন দেখতে পান। তখন ব্রজের গোপীগণ বলেন কে এই মহাভাগ্যবতী নারী, যাঁর পদচিহ্ন সম্মুখে দেখা যাচ্ছে।
কস্যাঃ পদানি চৈতানি যাতায়া নন্দসূনুনা। অংসন্যস্তপ্রকোষ্ঠায়াঃ করেণোঃ করিণা যথা॥ অনয়ারাধিতো নূনং ভগবান্ হরিরীশ্বরঃ।
যন্নো বিহায় গোবিন্দঃ প্রীতো যামনয়দ রহঃ ॥ (শ্রীমদ্ভাবগতপুরাণ: ১০.৩০.২৭-২৮)
“হস্তিনী যেমন নিজের প্রণয়ী গজরাজের সঙ্গে গমন করে তেমনভাবে নন্দের নন্দন শ্রীকৃষ্ণের কাঁধে নিজের হাত রেখে তাঁর পাশে পাশে চলেছেন কে এই মহাভাগ্যবতী? যাঁর পদচিহ্ন আমরা সম্মুখে দেখতে পাচ্ছি। অবশ্যই ইনি সর্বশক্তিমান ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সর্বশ্রেষ্ট ‘আরাধিকা’ যে জন্য আমাদের ছেড়ে শ্রীগোবিন্দ এঁরই প্রীতিবশে একা তাঁকে নিয়ে নির্জনে চলে গিয়েছেন।”
‘অনয়ারাধিতো’ অর্থাৎ অন্য কোনো গোপীকর্তৃক আরাধিতা শব্দের মধ্যেই বৈষ্ণবশাস্ত্রকারগণ শ্রীমতী রাধারাণীকে খুঁজে পেয়েছেন। বিষয়টি সনাতন গোস্বামী এবং জীব গোস্বামীকে অনুসরণ করে শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজও শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের আদিলীলায় বলেছেন।
“কৃষ্ণময়ী কৃষ্ণ যাঁর ভিতরে বাহিরে।
যাঁহা যাঁহা নেত্র পড়ে তাঁহা তাঁহা কৃষ্ণ স্ফুরে।
কিম্বা প্রেমরসময় কৃষ্ণের স্বরূপ।
তাঁর শক্তি তাঁর সহ হয় একরূপ ॥
কৃষ্ণবাঞ্ছা-পূর্তি-রূপ করে আরাধনে।
অতএব রাধিকা নাম পুরাণে বাখানে।”
(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত: আদিলীলা, ০৪)
শ্রীকৃষ্ণপ্রিয়া শ্রীমতী রাধারাণীর নাম শ্রীমভাগবতে আক্ষরিক অর্থে না থাকলেও শ্রীমদ্ভাগবতে বিশেষ একজন গোপীশ্রেষ্ঠার কথা বর্ণিত হয়েছে। সেই গোপীশ্রেষ্ঠা যে শ্রীকৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয় এ বিষয়টি সুস্পষ্ট। প্রাচীন পুরাণগুলোর মধ্যে অন্যতম বিষ্ণুপুরাণে শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণের ন্যায় রাসলীলা বর্ণিত হয়েছে। সেখানেও পুণ্যবতী এক গোপীশ্রেষ্ঠার কথা বলা হয়েছে যা শ্রীমতি রাধারাণীকেই প্রকারান্তরে নির্দেশ করে।
বিলোক্যৈকা ডুবং গ্রাহ গোপী গোপবরাঙ্গনা। পুলকাঞ্চিতসর্বাঙ্গী বিকাসিনয়নোৎপলা॥ ধ্বজবজ্রাঙ্কুশাজান্তরেখাবস্থ্যালি পশ্যত।
পদ্যন্যেতানি কৃষ্ণস্য লীলাললিতগামিন॥
কাপি তেন সমায়াতা কৃতপুণ্যা মদালসা।
পদানি তস্যাশ্চৈতানি ঘনান্যাল্পতনুনি চঃ॥
(বিষ্ণুপুরাণ: ০৫. ১৩.৩১-০০)
“পদ্মের ন্যায় চক্ষুবিশিষ্ট এক সুন্দরী গোপনারী আনন্দিত নয়নে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন-ওরে অলি। এই লীলাললিতগামী শ্রীকৃষ্ণের ধ্বজা, বজ্র, অঙ্কুশ এবং কমল ইত্যাদির রেখা দ্বারা সুশোভিত পদচিহ্ন দর্শন করে এবং আরও দেখো, তাঁর সাথে কোনো পুণ্যবতী যুবতীও এসে পড়েছেন, তাঁর সেই ছোট ছোট পদচিহ্নও দেখা যাচ্ছে।”
গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের অত্যন্ত প্রিয় একটি গ্রন্থ ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে শ্রীরাধাতত্ত্ব সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। প্রকৃতিখণ্ডের প্রথম অধ্যায়ের শুরুতেই নারদ বলেন, দুর্গা, রাধা, লক্ষ্মী, সরস্বতী এবং সাবিত্রী সৃষ্টিকার্যে আদ্যাশক্তির পঞ্চস্বরূপ। একইকথা দেবীভাগবতেও বর্ণিত হয়েছে।
নারদ উবাচ।
গণেশজননী দুর্গা রাধা লক্ষ্মীঃ সরস্বতী।
সাবিত্রী চ সৃষ্টিবিধৌ প্রকৃতিঃ পঞ্চধা স্মৃতা॥
(ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ: প্রকৃতিখণ্ড, ০১.০১: দেবীভাগবতপুরাণ: ০৯, ০১.০১)
অদ্যাশক্তির পঞ্চস্বরূপ সংক্রান্ত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এই শ্লোকটি ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের সাথে সাথে দেবীভাগবতেও রয়েছে। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ (প্রকৃতিখণ্ড, ০১. ৪১-৫৪) ও দেবীভাগবতে (০৯.০১. ৪৪-৫৭) শ্রীরাধাতত্ত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে-যিনি প্রেম ও প্রাণের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, যিনি পঞ্চবিধ প্রাণ-স্বরূপা, যিনি বিষ্ণুর প্রাণাধিকা ও প্রিয়তমা, যিনি শ্রেষ্ঠা ও সুন্দরী, যিনি সকলের আদিভূতা, যিনি সমস্ত সৌভাগ্যশালিনী, যিনি মানিনী ও গৌরবে পরিপূর্ণা, যিনি গুণ ও তেজের গর্বে বিষ্ণুর বাম-অঙ্গস্বরূপা, যিনি পরাৎপরা, সর্বব্রতনিরতা, যিনি পরমাদ্যা সনাতনী, যিনি পরমানন্দাস্বরূপিণী, যিনি ধন্যা, মান্যা ও পূজনীয়া, যিনি পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের রাসক্রীড়ার অধিষ্ঠাত্রী দেবী, রাসমণ্ডলের নিমিত্ত উৎপন্না, রাসমণ্ডল দ্বারা ভূষিতা, যিনি রাসের ঈশ্বরী সুরসিকা, যিনি রাসবাসে নিয়ত অবস্থান করেন, যিনি গোলকবাসিনী ও গোপীবেশধারিণী, যিনি পরম আল্লাদরূপিণী, যিনি সন্তোষ ও হর্ষরূপিণী, যিনি নির্গুণা ও নিরাকারা, সর্বত্রই নির্লিপ্তা অথচ আত্মস্বরূপা, যিনি চেষ্টাশূন্যা নিরহংকারা এবং ভক্তের প্রতি অনুগ্রহবশত শরীরধারণকারিণী, তাঁকে পণ্ডিতগণ বেদানুসারে ধ্যানে জানতে পারেন, কিন্তু তিনি তত্ত্বজ্ঞ সুরেন্দ্র এবং মুনিশ্রেষ্ঠগণেরও দৃষ্টির বিষয় নন। তিনি বহ্নির ন্যায় শুদ্ধবন্ত্রপরিধানা ও নানাবিধ রত্নের অলংকারে বিভূষিতা।
তিনি কোটি চন্দ্রের ন্যায় প্রভাশালিনী, মনোহর শোভাযুক্তা, ভক্তানুগ্রহে বিগ্রহধারিণী, ভক্তকে কৃষ্ণদাস্যদানে একমাত্র তিনিই সমর্থা এবং তিনিই ভক্তকে নিখিল সম্পত্তি প্রদান করেন। যিনি বরাহকল্পে বৃকভানু-সুতা হয়েছেন। যাঁর পাদপদ্ম স্পর্শ করে বসুধা নিরন্তর পবিত্রা, যিনি ব্রহ্মাদিরও দর্শনগোচর নন-অথচ সমস্ত জগতের দৃষ্টির বিষয় তিনি। হে মুনে, সেই স্ত্রীরত্বের সারভূতা নবীন-জলদ- জালে চঞ্চলা সৌদামিনীর ন্যায় কৃষ্ণের বক্ষঃস্থলে নিরন্তর অবস্থান করছেন। যাঁর পাদপদ্মের নখদর্শনের জন্য ব্রহ্মা যষ্টি সহস্রবৎসর তপস্যা করেও প্রত্যক্ষ করা দূরে থাক, স্বপ্নেও দর্শন করতে সমর্থ হন নি। তবে বৃন্দাবনে লোকসমন্ত নিরন্তর তাঁকে দর্শন করছে-এই হলো পঞ্চমীপ্রকৃতি দেবী রাধার তত্ত্ব। দেবীভাগবতের নবমস্কন্ধে শ্রীরাধার পূজা সম্পর্কে বলা হয়েছে, শ্রীরাধার পূজা ব্যতীত মনুষ্যের শ্রীকৃষ্ণপূজার অধিকার জন্মে না। তাই সকল বৈষ্ণবের শ্রীমতী রাধার পূজা করা কর্তব্য।
কৃষ্ণার্চ্চায়াং নাধিকারো যতো রাধার্চ্চনং বিনা।
বৈষ্ণবৈঃ সকলৈস্তস্মাৎ কর্তব্যং রাধিকার্চ্চনম্॥ কৃষ্ণপ্রাণাধিদেবী সা তদধীনো বিভূর্যতঃ।
রাসেশ্বরী তস্য নিত্যং তয়া হীনো ন তিষ্ঠতি॥
(দেবীভাগবতপুরাণ: ০৯. ৫০.১৬-১৭)
“রাধিকার পূজা ব্যতীত শ্রীকৃষ্ণ পূজার অধিকার লাভ হয় না, তাই সকল বৈষ্ণবেরই শ্রীরাধার পূজা করা কর্তব্য। শ্রীরাধাকৃষ্ণের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা, শ্রীকৃষ্ণ রাধার অধীন। শ্রীরাধা সর্বদা শ্রীকৃষ্ণের রাসেশ্বরী, তাই শ্রীকৃষ্ণ ক্ষণকালের জন্যও শ্রীরাধিকাবিহীন থাকতে পারেন না।”
বায়ুপুরাণে শ্রীমতী রাধার প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে, শ্রীরাধা-বিলাস-রসিক পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণই বেদাদি শাস্ত্রের একমাত্র জ্ঞাতব্য বিষয়।
রাধাবিলাসরসিকং কৃষ্ণাখ্যাং পুরুষং পরম্।
শ্রুতবানস্মি বেদেভ্যো যতস্তদেগাচরোহভবৎ।
(বায়ুপুরাণ: ১০৪. ৫২)
“আমরা বেদশাস্ত্র হতে শ্রবণ করেছি যে, শ্রীরাধা- বিলাস-রসিক ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পরম পুরুষই আত্মস্বরূপ অক্ষরের আত্মরূপে অবস্থিত এবং ইনিই বেদের একমাত্র জ্ঞাতব্য বিষয়।”
বরাহপুরাণে বলা হয়েছে-বৃন্দাবনের যে স্থানে শ্রীরাধা শ্রীকৃষ্ণকে আলিঙ্গন করেন, সেখানে শ্রীমতী রাধার জন্য একটি কুণ্ড তৈরি করা হয়, সেই কুণ্ডের নাম ‘রাধাকুণ্ড’।
অত্র রাধা সমাশ্লিষ্য কৃষ্ণমক্লিষ্টকারণম্।
স্বনাম্না বিধিতং কুণ্ডং কৃতং তীর্থং অদূরতঃ॥ রাধাকুণ্ডমিতি খ্যাতং সর্বপাপহরং শুভম্। অরিষ্টরাধাকুণ্ডাভ্যাং স্নানাং ফলমবাপুয়াৎ॥
(বরাহপুরাণ: ১৬৪.৩৩-৩৪)
“ঐ স্থানে রাধা অক্লিষ্টকর্মা কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করেন। ঐ স্থানে রাধার জন্য একটি কুণ্ড প্রস্তুত হয়। ঐ কুণ্ড রাধাকুণ্ড নামে প্রসিদ্ধ এবং এটা অরিষ্টকুণ্ডের অদূরে অবস্থিত। অরিষ্ট ও রাধাকুণ্ড উভয়েই পাপহর ও উভয়েই শুভফলপ্রদ।”
মৎস্যপুরাণেও শ্রীরাধার উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, শিবকুণ্ডে শিবানন্দা, দেবীতটে নন্দিনী, দ্বারাবতী ধা দ্বারকায় তিনি রুক্মিণী এবং বৃন্দাবনে শ্রীরাধা।
শিবকুণ্ডে শিবানন্দা নন্দিনী দেবিকাতটে।
রুক্মিণী দ্বারবত্যান্ত রাধা বৃন্দাবনে বনে॥
(মৎস্যপুরাণ: ১৩.৩৮)
“শিবকুণ্ডে শিবানন্দা, দেবীতটে নন্দিনী, দ্বারাবতী বা দ্বারকায় তিনি রুক্মিণী এবং বৃন্দাবনে রাধা।”
স্কন্দপুরাণের বিষ্ণুখণ্ডে শ্রীমতী রাধা প্রসঙ্গে কালিন্দী বলেন-পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের আত্মা শ্রীরাধিকা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের যে সকল নায়িকা তাঁরা সকলেই শ্রীমতী রাধিকার অংশ।
শ্রীকালিন্দ্যুবাচ।
আত্মরামস্য কৃষ্ণস্য ধ্রুবমাত্মান্তি রাধিকা।
তস্যা দাস্যপ্রভাবেণ বিরহোংস্মান্ন সংস্পৃশেৎ ॥
তস্যা এবাংশবিস্তারাঃ সর্বাঃ শ্রীকৃষ্ণনায়িকাঃ। নিত্যসম্ভোগ এবান্তি তস্যাঃ সাম্মুখ্যযোগতঃ॥ (স্কন্দপুরাণ: বিষ্ণুখণ্ড, ভাগবতমাহাত্ম্য, ০২. ১১-১২)
“কালিন্দী বললেন, আত্মারাম কৃষ্ণের আত্মা রাধিকা, আমি তাঁর দাসী, তাঁর দাস্য প্রভাবেই কাতরতা আমাকে স্পর্শ করতে অসমর্থ, সন্দেহ নেই। কৃষ্ণের যে সকল নায়িকা, তাঁরাও সেই রাধিকার অংশ বিস্তার জানবে; রাধিকার সাথে নিত্য কৃষ্ণের সম্ভোগ-যোগ বিদ্যমান; অতএব রাধিকাযোগে অপর নায়িকারা কৃষ্ণের সাথে সম্বন্ধযুক্ত হন।”
মহাভাগবতপুরাণে শ্রীরাধা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দিব্য সিংহাসনে উপবিষ্ট এবং পরম সুন্দরী শ্রীরাধা তাঁর বামাঙ্গে বিরাজিতা।
ব্যলোকরন মুখাম্ভোজং সুপ্রসন্নং নিরন্তরম্।
কদাচিদুপবিষ্টত্ত দিব্যসিংহাসনোপরি ॥
বামাঙ্কে সমুপাদায় রাধাং পরমসুন্দরীম্।
বিমৃজ্য শশিকোট্যাভাং বাসসা তন্মুখাম্বুজম্॥
(শ্রীমহাভাগবত: ৫৩. ১০-১১)
“শ্রীকৃষ্ণও কখনো সহাস্যবদনে সুন্দর মালা তাঁদের গলায় দিয়ে তাঁদের সর্বদা সুপ্রসন্ন মুখপদ্ম অবলোকন করতেন। শ্রীকৃষ্ণ কখনও দিব্য সিংহাসনে উপবিষ্ট; পরম সুন্দরী শ্রীরাধা তাঁর বামঙ্গে বিরাজিতা।”
পদ্মপুরাণের ব্রহ্মখণ্ডে শ্রীমতী রাধার জন্ম সম্পর্কে বলা হয়েছে-ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে বৃষভানুর যজ্ঞস্থলে শ্রীমতী রাধা আবির্ভূতা হয়েছেন।
ইতি শ্রুত্বাপি সা রাধাপ্যাগতা পৃথিবীং ততঃ।
ভাদ্রে মাসে সিতে পক্ষে অষ্টমীসংজিকে তিথৌ॥ বৃষভানোর্যজ্ঞভূমৌ জাতা সা রাধিকা দিবা।
যজ্ঞার্থং শোধিতায়াঞ্চ দৃষ্টা সা দিব্যরূপিণী॥
(পদ্মপুরাণ: ব্রহ্মখণ্ড, ০৭, ৪০-৪১)
“রাধা এই কথা শুনে পৃথিবীতে আগমন করলেন। ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষে অষ্টমী তিথিতে রাধিকাদেবী বৃষভানুর যজ্ঞস্থলে জন্মগ্রহণ করলেন। যজ্ঞার্থে শোধিত ভূতলে সেই দিব্যরূপিণী রাধা পরিদৃষ্ট হলেন।”
পদ্মপুরাণের ব্রহ্মখণ্ডে শ্রীরাধাষ্টমীর মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে পিতামহ ব্রহ্মা বলেছেন-যাঁরা ভক্তিভরে এক বার মাত্র শ্রীরাধাষ্টমীর ব্রত অনুষ্ঠান করে তাঁদের কোটি জন্মের ব্রহ্মহত্যাদির ন্যায় মহাপাপও তৎক্ষণাৎ বিনষ্ট হয়ে যায়।
ব্রহ্মোবাচ।
রাধাজন্মাষ্টমীং বৎস শূনুষ্ব সুসমাহিতঃ।
কথায়ামি সমাসেন সমগ্রং হরিণা বিনা ॥
কথিতুং তৎফলং পুর্ণ্যং ন শক্লোত্যপি নারদ। কোটিজন্মার্জিতং পাপং ব্রহ্মহত্যাদিকং মহৎ॥
কুর্ব্বন্তি যে সকৃষ্ণদ্ভক্ত্যা তেষাং নশ্যতি তৎক্ষণাৎ। একাদশ্যাঃ সহস্রেণ যৎফলং লভতে নরঃ। রাধাজন্মাষ্টমীপুণ্যং তন্মাচ্ছতগুণাধিকিম্ ॥ মেরুতুল্যসুবর্ণানি দত্বা যৎ ফলমাপ্যতে।
সকূদ্রাধাষ্টমীং কৃত্বা তস্মাচ্ছতগুণাধিকম্ ॥
(পদ্মপুরাণ: ব্রহ্মখণ্ড ০৭.০৬-০৯)
“ব্রহ্মা বললেন বৎস, শ্রীরাধাষ্টমীর বিবরণ সম্যকরূপে শ্রবণ করো, আমি সংক্ষেপে বলছি। হে নারদ, একমাত্র শ্রীহরি ব্যতিত শ্রীরাধাষ্টমীর ব্রতের সমগ্র পুণ্যফল কেউ জ্ঞাত নয়। যাঁরা ভক্তি ভরে একবার মাত্র এই ব্রতের অনুষ্ঠান করেন, তাঁদের কোটি জন্মের অর্জিত ব্রহ্মহত্যাদি মহাপাপের তৎক্ষণাৎ বিনাশ ঘটে। সহস্র একাদশীব্রত করলে মনুষ্য যে ফল লাভ করে, শুধু শ্রীরাধাষ্টমী ব্রত করলে সে সহস্র একাদশীব্রতের থেকে শতগুণ অধিক পুণ্য লাভ হয়। মেরুপ্রমাণ সুবর্ণ দান করে মানব যে ফল লাভ করে, একবার মাত্র শ্রীরাধাষ্টমী ব্রত করলে সে মেরুপ্রমাণ সুবর্ণ দানের পুণ্যফল থেকেও শতগুণ অধিক পুণ্যফল লাভ হয়।”
পদ্মপুরাণের স্বর্গখণ্ডেও শ্রীরাধাষ্টমীব্রতের মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, যে মূঢ় শ্রীরাধাষ্টমীব্রতের অনুষ্ঠান করে না শতকোটি কল্পেও সে নরক থেকে নিষ্কৃতি পায় না।
রাধাষ্টমীব্রতং তাত যো ন কুর্য্যাচ্চ মূঢ়ধীঃ। নরকান্নিষ্কৃতির্নান্তি কোটিকল্পশতৈরপি॥
(পদ্মপুরাণ: স্বর্ণখণ্ড, ৪০, ৩২)
“হে তাত। যে মুঢ়ধী রাধাষ্টমীব্রত করে না, শতকোটি কল্পেও সে নরক হতে নিষ্কৃতি পায় না।”
শ্রীমতী রাধারাণী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিবাহিত পত্নী। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ এবং গর্গসংহিতায় সে বিবাহের কথা বর্ণিত হয়েছে। শ্রীরাধা-কৃষ্ণের বিবাহ প্রসঙ্গে শ্রীব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের কৃষ্ণজন্মখণ্ডে বলা হয়েছে:
তদা ব্রহ্মা তয়োর্মধ্যে প্রজ্বাল্য চ হুতাশনম্।
হরিং সংস্কৃত্য হবনং চকার বিধিনা বিধিঃ॥
উত্থায় শয়নাৎ কৃষ্ণ উবাস বহ্নিসন্নিধৌ।
ব্রহ্মণোক্তেন বিধিনা চকার হবনং স্বয়ম্ ॥
প্রণম্য চ হরিং রাধাং দেবানাং জনকঃ স্বয়ম্।
তাঞ্চ তং কারয়ামাস সপ্তধা চ প্রদক্ষিণম্ ॥
পুনঃ প্রদক্ষিণং রাধাং কারয়িত্বা হুতাশনম্।
প্রণম্য চ পুনঃ কৃষ্ণং বাসয়ামাস তাং বিধিঃ ॥
তস্যা হস্তঞ্চ শ্রীকৃষ্ণং গ্রাহয়ামাস তদ্বিধিঃ।
বেদোক্তসপ্তমন্ত্রাংশ্চ পাঠয়ামাস মাধবম্ ॥
সংস্থাপ্য রাধিকাহস্তং হরের্বক্ষসি বেদবিৎ।
শ্রীকৃষ্ণহস্তং রাধায়াঃ পৃষ্ঠদেশে প্রজাপতিঃ।
স্থাপয়িত্বা চ মন্ত্রাংশ্চ পাঠয়ামাস রাধিকাম্ ॥
পারিজাতপ্রসূনানাং মালামাজানুলম্বিতাম্।
শ্রীকৃষ্ণস্য গলে ব্রহ্মা রাধাদ্বারা দদৌ মুদা ॥
প্রণময্য পুনঃ কৃষ্ণং রাধাঞ্চ কমলোদ্ভবঃ।
রাধাগলে হরিদ্বারা দদৌ মালাং মনোরমাম্ ॥
পুনশ্চ বাসয়ামাস শ্রীকৃষ্ণং কমলোদ্ভবঃ।
তদ্বামপার্শ্বে রাধাঞ্চ সম্মিতাং কৃষ্ণচেতসম্ ॥
পুটাঞ্জলিং কারয়িত্বা মাধবং রাধিকাং বিধিঃ।
পাঠয়ামাস বেদোক্তান্ পঞ্চ মন্ত্রাংশ নারদ ।
প্রণময্য পুনঃ কৃষ্ণং সমর্থ্য রাধিকাং বিধিঃ।
কন্যকাঞ্চ যথা তাতো ভক্ত্যা তসৌ হরেঃ পুরঃ ॥
এতস্মিন্নন্তরে দেবাঃ সানন্দপুলকোদগমাঃ।
দুন্দুভিং বাদয়ামাসু-রানকং মুরজাদিকম্ ॥ পারিজাতপ্রসূনানাং পুষ্পবৃষ্টিং চকার হ।
জগুর্গন্ধর্বপ্রবরা ননৃতুশ্চান্সরোগণাঃ ॥
(ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ: কৃষ্ণজন্মখণ্ড, ১৫, ১২৪-১৩৬)
“ব্রহ্মা ভক্তিপূর্বক রাধাকৃষ্ণকে প্রণাম করলেন এবং তাঁহাদের মধ্যে অগ্নি প্রজ্বলিত করে শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করে বিবিধক্রমে হোম করতে লাগলেন। তখন কৃষ্ণ শয্যা হতে উত্থান করে অগ্নি সমীপে উপবেশনপূর্ব্বক ব্রহ্মোক্ত বিধিক্রমে স্বয়ং হোম করতে আরম্ভ করলেন। বেদকর্তা ব্রহ্মা শ্রীকৃষ্ণ ও রাধিকাকে প্রণাম করে তাঁদেরকে সপ্তবার প্রদক্ষিণ করালেন। পুনরায় রাধিকাকে অগ্নি প্রদক্ষিণ করিয়ে তাঁকে এবং কৃষ্ণকে প্রণাম করে দেবীকে উপবেশন করালেন। এরপরে ব্রহ্মা রাধিকার হস্ত কৃষ্ণকে ধরতে বললেন, ভগবান্ সেই হস্ত ধারণ করলে তাঁকে বেদোক্ত সপ্তমন্ত্র পাঠ করালেন। ব্রহ্মা রাধিকার হস্ত কৃষ্ণের বক্ষঃস্থলে ও কৃষ্ণের হস্ত রাধিকার পৃষ্ঠদেশে স্থাপন করে রাধিকাকে মন্ত্রসমূহ পাঠ করালেন এবং আজানুলম্বিত পারিজাতকুসুমের মালা রাধাদ্বারা কৃষ্ণের গলায় অর্পণ করালেন। এরপরে কমলোদ্ভব কৃষ্ণ ও রাধিকাকে প্রণাম করে কৃষ্ণদ্বারা রাধিকা গলেও মনোহর মালা প্রদান করালেন। কমলোস্তব কৃষ্ণকে বসিয়ে তাঁর বামপার্শ্বে কৃষ্ণের চিত্তস্বরূপা সস্মিতা রাধিকাকে উপবেশন করালেন। হে নারদ! রাধা-কৃষ্ণকে হস্তজোড় করিয়ে, বেদোক্ত পঞ্চমন্ত্র পাঠ করালেন। অনন্তর কৃষ্ণকে রাধিকা দ্বারা প্রণাম করালেন। পিতা যেরূপ কন্যাকে প্রদান করে, সেইরূপ বিধাতা ব্রহ্মাও রাধিকাকে কৃষ্ণের হাতে সমর্পণ করে তাঁদের পুরোভাগে অবস্থান করিতে লাগলেন। সে সময়ে দেবগণ আনন্দে পুলকিত হয়ে দুন্দুভি, পটহ ও মুরজাদি বাদ্য বাজাতে এবং পারিজাত ফুল বর্ষণ করতে লাগলেন। গন্ধর্বগণ মধুপান করতে লাগলো এবং অন্দরাগণ মনোহর নৃত্য করতে লাগলো।”
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীমতী রাধার বিবাহের একই প্রকারের বর্ণনা গর্গমুনি রচিত গর্গসংহিতাতেও পাওয়া যায়:
শ্রীনারদ উবাচ।
তদা স উত্থায় বিধিহুতাশনং প্রজাল্য কুণ্ডে স্থিতয়োন্তয়োঃ পুরঃ।
শ্রুতেঃ করগ্রাহবিধিং বিধানতো বিধায় ধাতা সমবস্থিতোহভবৎ॥
স বাহয়ামাস হরিঞ্চ রাধিকাং প্রদক্ষিণং সপ্ত হিরণ্যরেতসঃ।
ততশ্চ তৌ তে প্রণময্য বেদবিত্তৌ পাঠয়ামাস চ সপ্তমন্ত্রকম্॥
ততো হরের্ব্বক্ষসি রাধিকায়াঃ করঞ্চ সংস্থাপ্য হরেঃ করং পুনঃ।
শ্রীরাধিকায়াঃ কিল পৃষ্ঠদেশকে সংস্থাপ্য মন্ত্রাংশ্চ বিধিঃ প্রপাঠয়ন ॥
রাধাকরাভ্যাং প্রদদৌ চ মালিকাং কিঞ্জল্কিনীং কৃষ্ণগলেহলিনাদিনীম্।
হরে করাভ্যাং বৃষভানুজাগলে ততশ্চ বহ্নিং প্রণময্য বেদবিৎ॥
সংবাসয়ামাস সুপীঠয়োশ্চ তৌ কৃতাঞ্জলি মৌনযুতৌ পিতামহঃ।
তৌ পাঠয়ামাস তু পঞ্চমন্ত্রকং সমর্থ্য রাধাঞ্চ পিতেব কন্যকাম্॥
(গর্গসংহিতা: গোলকখণ্ড, ১৬, ৩০-৩৪)
“নারদ বললেন, তখন ব্রহ্মা উত্থিত হয়ে উপবিষ্ট রাধাকৃষ্ণের সম্মুখে কুণ্ডমধ্যে যথাবিধি অগ্নি প্রজ্জলন করলেন এবং বৈদিক বিধি অনুসারে পাণিগ্রহণ ক্রিয়া সম্পাদন করে উপবিষ্ট হলেন। বেদ-বিধিজ্ঞ ব্রহ্মা রাধাকৃষ্ণের সপ্তবার অগ্নি প্রদক্ষিণ ও তাঁদের প্রণাম করালেন এবং এরপরে সপ্তমন্ত্র পাঠ করিয়ে বিবাহ বিধি সম্পন্ন করলেন। অনন্তর ব্রহ্মা রাধিকার হস্ত কৃষ্ণের বক্ষঃস্থলে এবং কৃষ্ণের হস্ত রাধিকার পৃষ্ঠদেশে সংস্থাপনপূর্ব্বক মন্ত্র পাঠ করালেন। বেদজ্ঞ ব্রহ্মা রাধা-করদ্বয় দ্বারা কৃষ্ণের গলায় ও কৃষ্ণ-করদ্বয় দ্বারা রাধার গলায় কেশরযুক্ত কমল-মাল্য প্রদান করিয়ে তাঁদের উভয়কেই অগ্নি প্রণাম করাইলেন; তখন তাঁদের গললগ্ন মালায় মধুকরগণ সুমধুর রব করছিল। অনন্তর পিতামহ কৃতাঞ্জলি মৌনযুক্ত রাধা-কৃষ্ণকে উত্তম আসনে উপবেশন করিয়ে পদ্মমন্ত্র পাঠ করালেন। পিতা যেমন বরকরে কন্যার্পণ করেন, পিতামহ ব্রহ্মাও তেমন করে রাধাকে শ্রীকৃষ্ণের হাতে অর্পণ করলেন।”
নারদ পঞ্চরাত্রে বলা হয়েছে-ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জগতের পিতা ও শ্রীমতী রাধিকা জগতের মাতা। পিতা অপেক্ষা মাতা শতগুণে পূজনীয়া ও শ্রেষ্ঠা।
শ্রীকৃষ্ণ জগতাং তাতো জগন্মাতা চ রাধিকা।
পিতৃ শতগুণে মাতা বন্দ্যা পূজ্যা গরীয়সী। (নারদপঞ্চরাত্র: দ্বিতীয় রাত্র, ০৬.০৭)
“ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জগতের পিতা ও শ্রীমতী রাধিকা জগতের মাতা। পিতা অপেক্ষা মাতা শতগুণে অধিক বন্দ্যা, পূজ্যা ও শ্রেষ্ঠা।”
দুধ এবং দুধের ধবলতার ন্যায় শ্রীরাধা ও শ্রীকৃষ্ণ অভেদ, এঁদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
রাধাচব্বিততামূলং চখাদ মধুসূদনঃ।
দ্বয়োশ্চৈকো ন ভেদশ্চ দৃগ্ধধাবল্যয়োর্যথা। (নারদপঞ্চরাত্র: দ্বিতীয় রাত্র, ০৬. ১৩)
“মধুসূদন রাধাচর্বিত তাম্বুল ভক্ষণ করেন। তারা দুজনেই এক, দুধ ও দুধের ধবলতার মধ্যে যেমন কোনো পার্থক্য নেই, তেমনি রাধা-কৃষ্ণও অভেদ স্বরূপ।”
★ লিখেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডঃ শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তীর ।