কুখ্যাত মঙ্গোল হানাদার তৈমুর লঙের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বলিউড অভিনেতা সঈফ আলি খান ও তার স্ত্রী অভিনেত্রী করিনা কাপুর খান তাদের ছেলের নাম রেখেছেন “তৈমুর” ৷ বামপন্থীরা হানাদার ইসলামি শাসকদের মহিমান্বিত করতে কোনো কসুর ছাড়ে না । কথিত ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা সম্প্রীতি রক্ষার নামে সেই রক্তাক্ত নৃশংস বর্বরোচিত ইতিহাসকে স্মরণ করতে চায়না । কিন্তু এভাবে দশকের পর দশক ধরে সত্য গোপনের মরিয়া চেষ্টা করেও তারা ইতিহাসের পাতা থেকে হানাদারদের নৃশংসতাকে মুছে ফেলতে পারেনি ।
মধ্যযুগে ভারতে ইসলামি হানাদাররা যে সমস্ত হিন্দু নরসংহার চালিয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম গনহত্যা চলে মঙ্গোল শাসক তৈমুর লঙের নেতৃত্বে । ভিনসেন্ট আর্থার স্মিথের “দ্য অক্সফোর্ড হিস্ট্রি অগ ইন্ডিয়া”য় বলা হয়েছে : ভারত শাসন করা নয়,বরঞ্চ ভারতের বিপুল সম্পদের উপর নজর ছিল এই ইসলামি হানাদারের ।
তৈমুর ১৩৭০ সালে ক্ষমতা অর্জন করার পরেই তিনি দ্রুত যুদ্ধে জড়িত হন এবং আশেপাশের অনেক দেশ জয় করেন। পারস্য এবং ইরাক জয় করার পর, দিল্লি সালতানাতের দিকে নজর পড়ে তৈমুরের । তখন দিল্লিতে গৃহযুদ্ধ চলছিল । ১৩৯৮ সালের দিকে, সেখানে দুজন শাসক ছিলেন যারা নিজেদেরকে সুলতান বলে ঘোষণা করেন৷ তাদের মধ্যে একজন হল ফিরোজ শাহ তুঘলকের নাতি নাসির উদ্দীন মাহমুদ শাহ তুঘলক এবং অন্যজন হল ফিরোজ শাহ তুঘলকের আর এক আত্মীয় নাসির উদ্দীন নুসরাত শাহ তুঘলক । নুসরাত শাহ দিল্লি থেকে কয়েক মাইল দূরে ফিরোজাবাদ থেকে শাসন করছিলেন । তৈমুর এই কথা শুনেছিলেন এবং তিনি ভারতের ধন-সম্পদের কথা জানতেন তাই দ্রুত দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা হন ।
স্মিথের বর্ণনা অনুযায়ী, ১৩৯৮ সালে, তৈমুর ভারত আক্রমণ করার জন্য ৯০,০০০ এরও বেশি সৈন্য সংগ্রহ করেছিলেন। ৩০ সেপ্টেম্বর ১৩৯৮ তারিখে তৈমুর সিন্ধু নদী পেরিয়ে তুলাম্বা পৌঁছান যেখানে তিনি শহরটিতে লুটতরাজ চালান এবং এর বাসিন্দাদের নির্বিচারে হত্যা করেন। পরে অক্টোবরে তিনি মুলতানে পৌঁছান এবং শহরটি দখল করেন। তার বেশিরভাগ আক্রমণ ভারতীয়দের দ্বারা কোন যুদ্ধ এবং প্রায় কোন প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়নি, কারণ তারা ইতিমধ্যেই দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং সঠিকভাবে সংঘবদ্ধ হয়নি। ১৩৯৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর দিল্লিতে একটি যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল । স্থায়ী হয়েছিল ৩ দিন ৷ ব্যাপক লুটপাটের পাশাপাশি সেই সময় ১০০,০০০ এরও বেশি মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে তৈমুর লঙ ।
দিল্লীর সুলতানরা ‘পৌত্তালিকতার উচ্ছেদ সাধন না করে হিন্দুদের প্রতি উদারতা প্রদর্শন করছে’—এই অজুহাতে তৈমুর লঙ ভারত আক্রমণ করেন । কিন্তু তার মূল উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুদের নরসংহার এবং ইসলামি শাসন কায়েম করা। দিল্লীর পথে দীপালপুর, ভাতনেইরসহ বিভিন্ন এলাকা লুণ্ঠন করে তিনি অসংখ্য নিরীহ নারী-পুরুষকে হত্যা করেন। দিল্লীর উপকণ্ঠে পৌঁছে তিনি প্রায় এক লক্ষ হিন্দু বন্দীকে একসঙ্গে হত্যা করে ইতিহাসে ভয়াবহতম হত্যাযজ্ঞের নজির স্থাপন করেন।
দিল্লীতে প্রবেশের পর তৈমুরের বাহিনী অকথ্য অত্যাচার চালায়। শহরের হিন্দুরা আত্মরক্ষার চেষ্টা করলে শুরু হয় ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও লুণ্ঠন। দিল্লী নগরী কয়েকদিন ধরে রক্তে রঞ্জিত ছিল। এর পর তিনি সিরি, জাহাপনা ও পুরাতন দিল্লীসহ আরও তিনটি শহরে একইভাবে পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড ঘটান। ঐতিহাসিকদের মতে, এই হত্যাকাণ্ড এত ভয়াবহ ছিল যে পরবর্তী দুই মাস দিল্লীর আকাশে কোনো পাখি উড়তে দেখা যায়নি। তৈমুর শুধু দিল্লীতেই হত্যাযজ্ঞ চালাননি, তার পুরো জীবনে তিনি প্রায় ১৭ মিলিয়ন মানুষ হত্যা করেছিলেন, যা সে সময়ের বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫ থেকে ৭ শতাংশ।
তৈমুর তার আত্মজীবনীতে এই হত্যাযজ্ঞ নিয়ে গর্ব করে লিখেছিল : “দিল্লিতে আমি ১৫ দিন ছিলাম। দিনগুলি আনন্দে কেটেছে। তারপর মনে পড়ল, আমি তো কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেই হিন্দুস্থানে এসেছি। খোদার দয়ায় আমি সর্বত্র সাফল্য পেয়েছি। লক্ষ লক্ষ কাফের হিন্দুকে বধ করেছি। ইসলামের পবিত্র তরবারি তাদের রক্তে ধৌত হয়েছে। এখন বিশ্রামের সময় নয়, বরং কাফেরদের বিরুদ্ধে নিরন্তর যুদ্ধ করা উচিত।”
এই হত্যাযজ্ঞের পর বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিম রাজকর্মচারীরা ঘোষণা করে— “হিন্দুরা ইসলাম গ্রহণ করো, নতুবা তৈমুরের বাহিনীকে খবর দেওয়া হবে।” এই ভয়ে বহু হিন্দু বাধ্য হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইতিহাসবিদদের মতে, এর ফলেই বাংলায় “শুনে মুসলমান” কথাটির প্রচলন ঘটে।
তৈমুরের মতোই হিন্দুবিদ্বেষী ছিল সুলতান সিকান্দার শাহ। তিনি হিন্দুদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরের নির্দেশ দেন এবং বহু হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেন। তার আদেশে মথুরার বিখ্যাত মন্দির ভেঙে ফেলা হয়, হিন্দুদের যমুনা নদীতে স্নান নিষিদ্ধ করা হয়। এমনকি, “হিন্দু ধর্ম ইসলাম ধর্ম অপেক্ষা কোন অংশেই হীন নহে”—এই কথা বলার অপরাধে এক জৈনক ব্রাহ্মণকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কাশ্মীরের হিন্দুরা তার অত্যাচারে বাধ্য হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে।
তৈমুরের দিল্লী আক্রমণ ছিল কেবল একটি সামরিক অভিযান নয়; এটি ছিল হিন্দু সংস্কৃতি ও অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পিত প্রয়াস। আজও ইতিহাসের এই অধ্যায় মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত ভয়ঙ্করতম অপরাধ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে ।। (সুত্রঃ- ভারত ইতিহাস কথা, ডক্টর কে সি চৌধুরী, পৃ-১৩৭ )